ঢাকাশুক্রবার, ২৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ফুটবল হয়তো আবিষ্কারই হয়েছে পেলের জন্য

নিউজ ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
ডিসেম্বর ৩০, ২০২২ ৮:৫৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ববি চার্লটন একবার বলেছিলেন, ফুটবল হয়তো আবিষ্কারই হয়েছে পেলের জন্য এবং নিশ্চিতভাবেই বেশির ভাগ ভাষ্যকার তার প্রশংসা করেন এভাবে যে তিনিই চমৎকার এ খেলাটির সবচেয়ে ভালো উদাহরণ।

গোলপোস্টের সামনে গিয়ে দক্ষতা আর বিদ্যুৎগতির নিখুঁত মিশ্রণ ঘটত পেলের; এবং নিজের এই নৈপুণ্যের সুবাদেই নিজের দেশ ব্রাজিলের একজন নায়ক হওয়ার পর তিনি হয়ে উঠেছিলেন বৈশ্বিক স্পোর্টিং আইকন।আর মাঠের বাইরে তিনি বরাবরই কাজ করেছেন সমাজের বঞ্চিত মানুষের জীবনমানের উন্নতির জন্য।

অ্যাডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো জন্মেছিলেন ব্রাজিলের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় শহর ট্রেস কোরাকোসে ১৯৪০ সালের ২৩শে অক্টোবর।

তবে তার জন্ম সনদে তার জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২১শে অক্টোবর। তবে পেলের মতে এটি সত্য নয়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ব্রাজিলে একেবারে নিখুঁত থাকা নিয়ে আমরা ততটা ব্যস্ত নই।’

তার নাম রাখা হয়েছিল বিশ্বখ্যাত মার্কিন বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনের নামে। পেলের মতে, এর কারণ—তার জন্মের কয়েকদিন আগে তার বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযুক্ত হয়েছিলো।

পরে অবশ্য ‘এডিসন’ থেকে ‘আই’ অক্ষরটি বাদ দিয়ে দেন বাবা মা, এবং তার নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় অ্যাডসন।

দারিদ্র্যের মধ্যেই বড় হয়েছেন পেলে। বাল্যকালে লোকাল ক্যাফেতে কাজ করে তিনি পরিবারের উপার্জনে সহায়তা করতেন।

বাবার কাছেই ফুটবল শিখেছেন তিনি। কিন্তু পরিবারের বল কেনার সামর্থ্য ছিলো না। সুতরাং তরুণ পেলেকে মাঝে মাঝেই কাপড়ের দলা পেঁচিয়ে বল বানিয়ে রাস্তায় খেলতে দেখা যেতো।

স্কুলে এসে বন্ধুদের কাছে তার নাম হয় পেলে। যদিও তিনি নিজে বা তার বন্ধুরা কেউ জানতেন না যে এর অর্থ কী।

পেলে অবশ্য তার এই ডাক নামটা কখনো পছন্দ করেননি। কারণ তার মনে হতো এটা পর্তুগীজ ভাষায় ‘শিশুদের কথার’ মতো।

কিশোর বয়সেই স্থানীয় কয়েকটি ফুটবল ক্লাবের সদস্য হয়ে খেলা শুরু করেন। ওই সময় ব্রাজিলে ইনডোর ফুটবল মাত্রই জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলো। তরুণ পেলে তার স্বাদ নেয়া শুরু করলেন।

পরে এক সাক্ষাৎকরে তিনি বলেছিলেন“আমি ইনডোর ফুটবলকে পানি থেকে মাছ ধরার মতো একটি ব্যাপার হিসেবে নিয়েছিলাম। মাঠের ফুটবলের চেয়ে এটা ছিলো আরও দ্রুতগতির- এখানে খেলোয়াড়দের দ্রুত চিন্তা করতে হতো।’

তিনি বাউরু অ্যাথলেটিক ক্লাব জুনিয়রকে নেতৃত্ব দিয়ে তিন বার রাজ্য যুব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন এবং তার মাধ্যমে নিজেকে উজ্জ্বল প্রতিভা হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন।

১৯৫৬ সালে তার কোচ ভালদেমার ডি ব্রিতো তাকে সান্তোস ক্লাবে নিয়ে যান, পেশাদার দল সান্তোস এফসিতে চেষ্টা করার জন্য। ডি ব্রিতো অবশ্য তার আগেই ক্লাব কর্তাদের রাজি করাতে পেরেছিলেন যে পেলেই একদিন বিশ্বসেরা খেলোয়াড় হবে।

১৯৫৬ সালে জুনে সান্তোসের সঙ্গে যখন চুক্তিবদ্ধ হন, তখন পেলের বয়স মাত্র পনের বছর।

শীর্ষ গোলদাতা

এক বছরের মধ্যেই সান্তোসের সিনিয়র টিমের জন্য নির্বাচিত হন পেলে এবং প্রথম ম্যাচেই গোল করেন তিনি। তারপর দ্রুত দলে জায়গা পাকা করে ফেলেন এবং প্রথম বছরেই লীগের শীর্ষ গোলদাতা হন। সান্তোসের সঙ্গে চুক্তির মাত্র দশ মাসের মাথায় ব্রাজিলের জাতীয় দলে ডাক পান তিনি।

মারাকানায় আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হয় তার এবং ওই ম্যাচে তার দল ২-১ গোলে হেরে যায়। ওই ম্যাচে একমাত্র গোলটি করেছিলেন ১৬ বছর বয়সী পেলে এবং তার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফুটবলে কনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ডটি নিজের করে নেন তিনি।

হাঁটুর ইনজুরির কারণে ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছিল পেলের। তবে ইনজুরি সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ তাকে দলে রাখে এবং বিশ্বকাপে তার অভিষেক হয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে।

জাতীয় সম্পদ

১৯৬০ সালের দিকে ইন্টার মিলান, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদের, ইউভেন্তাসের মতো বিভিন্ন ধনী ইউরোপীয় ক্লাব পেলেকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, কারণ ইতোমধ্যেই বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলার হওয়ার যাবতীয় ইঙ্গিত দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল তার মধ্যে।

কিন্তু এ পথে বাধ সাধেন ব্রাজিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জানু কুয়াদরুস। ১৯৬১ সালে পেলেকে ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ’ ঘোষণা করেন তিনি।

অবশ্য তার প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে হয়েছে ব্রাজিল ও পেলে— উভয়কেই। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ ছিল ব্রাজিলের জন্য হতাশার। পেলে ছিলেন সবার লক্ষ্যবস্তু। সেই আসরে প্রতিপক্ষ বিভিন্ন দলের বহু আক্রমণ ও আঘাত (ফাউল) সহ্য করতে হয়েছে তাকে। ফলে তার সেরা খেলাটা খেলার সুযোগ পাননি পেলে।

কিন্তু নিজেদের তারকা হারানোর ভয়ে ব্রাজিলের সরকার পেলেকে ‘জাতীয় সম্পদ’ ঘোষণা করে তার বিদেশে চলে যাওয়া ঠেকানোর জন্য।

সবচেয়ে সেরা দল

১৯৬৯ সালে পেলে তখন ত্রিশের দোরগোড়ায়। ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে খেলবেন কিনা—তা নিয়ে কিছুটায় দ্বিধায় ছিলেন।

দেশের সামরিক স্বৈরাচার এ সময় তার বিরুদ্ধে একটি তদন্তও করছিলো। অভিযোগ ছিলো—পেলে বামপন্থীদের প্রতি সদয়।

শেষ পর্যন্ত ওই বিশ্বকাপে তিনি খেললেন এবং সেই আসরেই ইতিহাসের সেরা দলের স্বীকৃতি পেলো ব্রাজিল। সবচেয়ে বিখ্যাত মুহূর্তটি ছিলো ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। তার হেড থেকে বল যখন নেটে ঢুকছিলো তখনি গর্ডন ব্যাংক তার বলটি ঠেকিয়ে দেন এবং সেটিই পরে খ্যাতি পায় ‘দ্যা সেইভ অফ দ্যা সেঞ্চুরি’ হিসেবে।

তা সত্ত্বেও ফাইনালে ইটালির বিরুদ্ধে ৪-১ গোলে জয় জুলে রিমে ট্রফির স্থায়ী গন্তব্যে পরিণত করে ব্রাজিলকে। পেলে অবশ্যই গোল করেছিলেন।

ব্রাজিলের জন্য তার শেষ খেলা ছিলো ১৯৭১ সালের ১৮ই জুলাই। রিও ডি জেনেরিয়ও শহরে আয়োজিত সেই ম্যাচটি ছিল যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে; আর ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফুটবল থেকে তিনি অবসর নেন ১৯৭৪ সালে।

দু বছর পর তিনি নিউইয়র্ক কসমসের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন এবং সেখানে তার নামই ফুটবলের ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়।

রাষ্ট্রদূত

১৯৭৭ সালে পেলের পুরনো দল তার অবসরকে সম্মানিত করতে কসমসের সাথে খেলার আয়োজন করে। তিনি খেলা দু অংশে দুই দলের হয়ে খেলেন।

সেসময় তিনি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ আয় করা খেলোয়াড়। অবসরের পরেও অর্থ আয় তার অব্যাহতই থাকে।

একটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন তিনি ১৯৮১ সালে। তার ছিলো অনেক বাণিজ্যিক স্পন্সরশীপ চুক্তি।

১৯৯২ সালে তাকে জাতিসংঘ পরিবেশ বিষয়ক দূত নিয়োগ করে। পরের বছল ইউনেস্কোর গুডউইল অ্যাম্বাসেডরও হন তিনি।

১৯৯৫ সালে ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রী হয়ে ফুটবল থেকে দুর্নীতি দূর করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যদিও দুর্নীতির অভিযোগেই ইউনেস্কো থেকে তাকে সরে যেতে হয়েছিল। তবে তদন্তে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ২০০৫ সালে তিনি বিবিসির স্পোর্টস পারসোনালিটি অফ দ্যা ইয়ার মনোনীত হয়েছিলেন।

বিয়ে

১৯৬৬ সালে পেলে বিয়ে করেছিলেন রোজমেরি ডোস রেইস ছলবিকে। এই দম্পতির দুই কন্যা আর এক পুত্র আছে। ১৯৮২ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। তারপর দ্বিতীয় বিয়ে করেন গায়িকা আসিরিয়া লেমোস সেইক্সাসকে। যমজ সন্তান বাবা মা ছিলেন তারা। ২০০৮ সালে সেই ঘরও ভেঙে যায়।

২০১৬ সালে জাপানি-ব্রাজিলিয়ান ব্যবসায়ী মার্সিয়া সিবেলে আওকির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন পেলে। এই নারীর সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিলো ১৯৮০ সালে।

বৈশ্বিক ব্র্যান্ড

ফুটবলে যাদের আগ্রহ ছিলো না বা নেই তাদের কাছেও পেলে সুপরিচিত। এমনকি একসময় কৌতুক হয়ে দাঁড়ায় যে বিশ্বে সত্যিকার অর্থেই তিনটি ব্রান্ড – যিশু, কোকা কোলা এবং পেলে।

পেলে ছিলেন বিশ্বের বিরল ব্যক্তিদের একজন যিনি তার খেলার মাধ্যমে সারাবিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন।