ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানিসংকট, পরিবহনভাড়া বৃদ্ধিসহ নানামুখী সমস্যার কারণে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক ক্ষতির মুখে আছে দেশের সিমেন্টশিল্প খাত। এই অবস্থার মধ্যেই সিমেন্টশিল্পের অন্যতম কাঁচামাল লাইমস্টোনের ওপর সম্প্রতি হঠাৎ ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং ৩ শতাংশ অগ্রিম আয়করের সঙ্গে আরো ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর আরোপ করা হয়েছে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে এই শিল্প বাঁচাতে সম্পূরক শুল্ক ছাড়সহ সরকারের নীতি সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)।
সংগঠনটির নেতারা বলছেন, এই অতিরিক্ত শুল্কায়নের ফলে বর্তমানে আমদানি মূল্যের ওপর প্রায় ২৭ শতাংশের পরিবর্তে প্রায় ৬৭ শতাংশ শুল্ক ও কর পরিশোধ করে লাইমস্টোন ছাড় করাতে হচ্ছে।
জরুরি ভিত্তিতে লাইমস্টোনের ওপর সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার না করা হলে ক্ষতিগ্রস্ত শুধু সিমেন্টশিল্পই হবে না, এতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন বিসিএমএর সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও মেট্রোসেম সিমেন্টের এমডি মো. শহিদুল্লাহ, প্রিমিয়ার সিমেন্টের এমডি মোহাম্মদ আমিরুল হক, বসুন্ধরা গ্রুপের সিমেন্ট সেক্টরের মহাব্যবস্থাপক (সেলস) মো. শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রমুখ।
আলমগীর কবির বলেন, বর্তমানে নানামুখী সমস্যায় দেশের উদীয়মান খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম সিমেন্টশিল্প এক কঠিন সময় পার করছে। সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমেই সিমেন্টশিল্পের এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব। সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য প্রধান কাঁচামাল হলো ক্লিংকার, স্লাগ, লাইমস্টোন, ফ্লাই অ্যাশ ও জিপসাম। এই পাঁচ কাঁচামালই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিএসটিআই ও ইউরোপীয় নর্মস অনুযায়ী সিমেন্ট উৎপাদনের ক্ষেত্রে লাইমস্টোন সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য। লাইমস্টোনের আমদানি মূল্য অন্যান্য কাঁচামালের আমদানি মূল্যের তুলনায় সবচেয়ে কম। সে হিসাবে সিমেন্ট উৎপাদনের ক্ষেত্রে লাইমস্টোন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী কাঁচামাল। তাই এর ওপর অতিরিক্ত শুল্কায়নের ফলে সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা লাইমস্টোন আমদানি করতে নিরুৎসাহ হবেন। এর ফলে বর্তমান ডলার সংকটের ওপর অতিরিক্ত চাপ বাড়বে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বিসিএমএ সভাপতি বলেন, ‘আমদানি পর্যায় ছাড়াও বিক্রি পর্যায়েও ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ধার্য করা আছে। অর্থাৎ একটি সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লোকসান করলেও তাকে চূড়ান্ত কর দায় হিসেবে এই অগ্রিম আয়কর পরিশোধ করতে হবে, যা কোনো বিবেচনায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে সিমেন্টশিল্পের ক্ষেত্রে অগ্রিম আয়করের কারণে দুরবস্থার বিষয়টি আমরা এর আগে বহুবার তুলে ধরেছি। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়টিতে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না, যার ফলে দেশের একটি উদীয়মান শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ’
আলমগীর কবির আরো বলেন, ‘আশা করছি, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়টি বিবেচনায় নেবে এবং আমদানি ও বিক্রি উভয় পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর সর্বোচ্চ ০.৫০ শতাংশ (০.৫০ শতাংশ) ধার্য করে চূড়ান্ত কর দায় থেকে মুক্ত করবে। ’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আড়াই দশক আগে সিমেন্টের প্রায় সম্পূর্ণ চাহিদা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হতো। কিন্তু এরপর উদ্যোক্তাদের সাহসী পদক্ষেপ ও সরকারের নীতি সহায়তার কারণে সিমেন্টশিল্প একটি বিকাশমান শিল্প ও তুলনামূলক সুসংগঠিত খাত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ বিদেশেও সিমেন্ট রপ্তানি করা হচ্ছে। দেশে প্রায় ৩৫টি দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান সিমেন্ট উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। এর বার্ষিক কার্যকর উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৭৯ মিলিয়ন টন, যার বিপরীতে চাহিদা রয়েছে প্রায় ৩৯ মিলিয়ন টন। চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণের বেশি উৎপাদনক্ষমতা থাকার কারণে বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে নামমাত্র মূল্যে সিমেন্ট বিক্রি করতে হয়। এতে আর্থিকভাবে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সম্মেলনে আরো জানানো হয়, নানা সংকটের কারণে সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানিতে বিঘ্ন ঘটছে, খরচ বেড়ে যাচ্ছে। নতুন করে এলসি খুলতে গিয়েও বর্তমানে বিরাট বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন সিমেন্ট খাতের শিল্প মালিকরা। গ্যাসসংকটের কারণে দেশ প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে সিমেন্টের স্থানীয় পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া সিমেন্ট রপ্তানির ওপর নগদ প্রণোদনার ব্যবস্থা না থাকায়ও এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার যদি এই খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা করে, ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়, তাহলে সিমেন্ট উৎপাদনকারীদের এই দুরবস্থা কিছুটা হলেও কমবে এবং দেশের সিমেন্টশিল্প প্রসারিত হবে।