ঢাকাশুক্রবার, ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার সামান্য অসুখেও মৃত্যু হচ্ছে

নিউজ ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
নভেম্বর ২৫, ২০২২ ৪:৪৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মুরাদ হাসান। তিনি প্রায় এক মাস ধরে মূত্র সংক্রমণে ভুগছিলেন। তিনি গত সোমবার আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে।

নেত্রকোনোর বাসিন্দা মুরাদ বলেন, ‘চিকিৎসকের ফি এক হাজার টাকা, এরপর নানা ধরনের পরীক্ষা করাতে হয়।

এভাবে অনেক টাকা চলে যায়। এ কারণে প্রথমে ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাই। কিন্তু ব্যথা কমছিল না। শেষে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে কিছুদিন ভালো ছিলাম। এরপর আবারও ব্যথা বাড়ে। এ জন্য আজ ঢাকার এই হাসপাতালে আসছি। ’

 

মুরাদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় বিএসএমএমইউতে গত সোমবার। দেশে প্রতিদিন ১৫ লাখ মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছে। তাদের বেশির ভাগই মুরাদের মতো চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই দোকান থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে খাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয়, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি, প্রাণীর মাংস বা শাক-সবজি উৎপাদনে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এবং হাসপাতালের পরিবেশজনিত কারণে দেশে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কার্যক্ষমতা অনেকাংশে কমে গেছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে সব জটিল রোগের চিকিৎসা। সামান্য অসুখেও মৃত্যু হচ্ছে মানুষের।

দেশের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য বলছে, ব্যয় বেশি হওয়ায় প্রায় তিন কোটি মানুষ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ জরুরি পরিস্থিতি না হলে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বিরত থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ এখনো চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ওষুধ সেবন করে থাকে। আর ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে প্রতিদিন ১৫ লাখ মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছে এবং তাদের বেশির ভাগই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ কিনছে।

বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, রোগীর রোগ নির্ণয় ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। হয়তো রোগীর প্রয়োজন আছে, কিন্তু সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে না। ভুল অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ভুল মাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে অথবা ভুল সময়ে ব্যবহার করা হচ্ছে।

অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, অনিচ্ছাকৃত বা যেভাবেই হোক এই ভুলগুলোর কারণে রোগীর শরীরে থাকা কিছু ব্যাকটেরিয়া বেঁচে যায় এবং ব্যাকটেরিয়াগুলো শরীরে বেঁচে থাকার কৌশল শিখে যায়, সেটাকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ফলে রোগী শুধু নিজের ক্ষতি করছে না, সামাজিকভাবে বা বৈশ্বিক ক্ষতির কারণ হচ্ছে।

রাজধানীর জিগাতলায় একটি ওষুধের দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট কিনছিলেন রিকশাচালক কামরুল। কী হয়েছে জানতে চাইলে তিনি জানান, রিকশার পেডালের খোঁচায় বাঁ পায়ের গোড়ালিতে কেটে গিয়েছিল। অনেক দিন হয়েছে শুকায় না, ঘা হয়েছে। এ জন্য এই ওষুধ নিচ্ছেন। চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন কি না—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ডাক্তারের কাছে গেলে তো মেলা টেহা দরকার। পরীক্ষাও দেয় অনেক। গরিব মানুষ এত টেহা পামু কই। আল্লায় দিলে আর কয়েক দিনে এই ঘা শুকাইয়া যাইব। ’

চলতি বছরের মে মাসে দেশের আট বিভাগের ৪২৭টি ফার্মেসির খুচরা ওষুধ বিক্রেতার ওপর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৬৭ শতাংশ খুচরা ওষুধ বিক্রেতার অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ নিয়ে ধারণা নেই। তাঁরা অ্যান্টিবায়োটিক চেনেন না।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনতা সপ্তাহ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর ১৮-২৪ নভেম্বর বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনতা সপ্তাহ পালন করে আসছে। এবারের সপ্তাহ পালিত হলো ‘অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস : সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করুন’ প্রতিপাদ্যে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, দেশে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে অন্তত ১৭টির কার্যক্ষমতা অনেকাংশে কমে গেছে। আইইডিসিআরের চলতি বছরের গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স আরো বেড়েছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জাকির হোসেন হাবিব।

২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল, নতুন ৩৬টি অ্যান্টিবায়োটিক আসছে। কিন্তু সমস্যা হলো, নতুন যে অ্যান্টিবায়োটিক আসছে সেগুলোর কার্যকারিতায় তেমন পরিবর্তন নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ কে লুত্ফুল কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, চিকিৎসকের কাছে না গিয়েই অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খাওয়া মানুষের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের। তারা মনে করে চিকিৎসকের কাছে গেলে এক হাজার টাকা ভিজিট দিতে হবে, এরপর তিনি আবার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেবেন, অপ্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ লিখে দেবেন। সেই ভয়ে মানুষ খুব বেশি খারাপ পরিস্থিতি না হলে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে না।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার ঠেকাতে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ ১৬ জেলায় প্রচারণা চলছে। অ্যান্টিবায়োটিক সহজে যেন চেনা যায়, সে জন্য ওষুধ কম্পানিগুলোকে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের মোড়কে লাল রং ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। সেটি অনেক প্রতিষ্ঠান করছে, কিছু করেনি। এটা শিগগিরই হয়ে যাবে। আর চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করলে ২০ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব করেছিলাম। সে প্রস্তাব শিগগিরই সংসদে উঠবে। ’