এক.
গণমানুষের রাজনীতিই নেতাকে বাঁচিয়ে রাখে-যেমনটা ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কূটিল বুদ্ধিতে কাউকে সাময়িক থামিয়ে দেয়া যায়,যার স্বপ্নই এগিয়ে যাওয়া আল্লাহ ছাড়া তাকে থামানোর শক্তি কোথায়?মাওলানা ভাসানীর জীবন কত উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গেল কিন্তু মানুষ তাকে মনে রেখেছে।মনে রাখবে।আমি মাঝে মাঝে অবাক হই-আওয়ামী লীগের অতিরিক্ত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ছল চাতুরী দেখে,যদিও এখন দলটি আদর্শিক ভাবে এখন আর কোনো পক্ষেই নেই!অথচ এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন একজন মাদ্রাসা পড়ুয়া মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।ক্ষমতার রাজনীতির ধারে কাছেও তিনি কখনও ছিলেন না,সারাজীবন দেশ আর মানুষের জন্য শর্তহীন লড়াই চালিয়ে গেছেন।ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ঊনসত্তর,একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ বিণির্মাণে তাঁর ভূমিকা অস্বীকার করলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই অর্থহীন।সাত চল্লিশে পাকিস্তান ও একাত্তরে বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন।চুয়ান্ন ‘র যুক্তফ্রন্টের শীর্ষস্থানীয় নেতা হয়েও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন সারাজীবন। কথা বলেছেন, লড়াই করেছেন কেবল সাধারণ মানুষের জন্যই।
চীনপন্থী মাওবাদী কমিউনিস্ট হিসাবে কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করতে চান!কেন তাঁকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতে এক ধরনের বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে,স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারেননি,সে আর এক নির্মম ইতিহাস।ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যেবাদের বিরুদ্ধে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম মাওলানা ভাসানী। পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের গোলামী করার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি।একজন মাওলানার মাওবাদী সমাজতান্ত্রিক নেতা হয়ে উঠায় তিনি রেড মাওলানা বা লাল মাওলানা নামেও পরিচিত ছিলেন।তিনি কোনো তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন না,কঠিন তত্ত্ব বুঝতেও চাননি।মানুষের কাছেই লড়াইয়ের ময়দানে রাজনৈতিক তালিমে সমৃদ্ধ করেছেন।তিনি ছিলেন প্রাকটিকাল লিডার।কোনো মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি ছিলেন না।বাংলাদেশের রাজনীতিতে মাওলানা ভাসানী একটা যুগের স্রষ্টা।একটা প্রজন্মের রাহবার,যারা রাজনীতিকে সমাজ পরিবর্তনের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার মনে করেছিল।রাজনীতি যে ভোগবিলাসের বিষয় নয়,ত্যাগের ব্যাপার,এটা মাওলানা ভাসানীর মতো এতোটা বাস্তবমুখী চিন্তা চেতনায় কেউ বুঝাতে পারেনি।
দুই.
বাংলাদেশের ইতিহাসে জোটের রাজনীতির প্রথম সূত্রপাত হয় মূলত ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে যার অন্যতম নেতা ছিলেন মাওলানা ভাসানী।তাঁর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামীলীগ যখন তিনি দেখলেন তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের সাথে বেমানান তখন স্বেচ্ছায়ই সরে এসেছেন।গড়ে তুলেছেন নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)যার প্রতীক ছিল ধানের শীষ!সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলে সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল ছিল ভাসানীর ন্যাপ।ন্যাপ সেই সময়ে প্রলংকরী ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কথা চিন্তা করে নির্বাচন পেছানোর দাবী করলেও,সরকার মানেনি।প্রতিবাদে ন্যাপও নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি!ফলে সহজেই পার পেয়ে যায় আওয়ামীলীগ!একটু ভেবে দেখুনতো যদি সেই নির্বাচনে ভাসানীর ন্যাপ অংশ নিত তাহলে আওয়ামীলীগের ফলাফল কেমন হত?
একাত্তর পরবর্তী সময়ে ন্যাপ মোজাফফর ও কমিউনিস্ট পার্টি যখন আওয়ামী সরকারের সাথে তিনদলীয় জোটে থাকাটাকেই পরোক্ষভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে থাকা মনে করলো[সত্যিকারের লুটপাটতন্ত্র] মাওলানা ভাসানীই তখন দুঃসাহসিক প্রতিবাদ করেছেন। তখন একমাত্র বিরোধী দল বলতেও ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকেই বুঝাতো।তিনি পিছু হটেননি।বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে কাগমারী সম্মেলনে ভাসানীই প্রথম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে বিদায় জানিয়ে ছিলেন।একজন মাওলানা তাও মাদ্রাসা পড়ুয়া একজন মানুষ কেন মাওবাদী হতে গেলেন? এই প্রশ্ন অনেকেই তোলেন!কিন্তু বাস্তবতা হলো তিনি মাওবাদের ভাল রাজনৈতিক দিকগুলোকে ধারণ করলেও ইসলাম থেকে চুল পরিমাণও বিচ্যুত হওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি,ছিলেন একজন কামেল পীরও।মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শনকে আমি মাওবাদ বলতেও একেবারেই নারাজ!মাওলানা হওয়ার পরেও কিছুটা মাওবাদী!অবাক বিস্ময়ই বটে!এজন্যই হয়ত তিনি রেড মাওলানা বা লাল মাওলানা হিসাবে খ্যাত।রাজনীতিকে যারা লাভজনক বিনিয়োগ, সুবিধাজনক ব্যবসা মনে করেন মাওলানা ভাসানীর দর্শন তাদের কাছে নিশ্চয়ই এক মূর্তিমান আতংকের নাম।
তিন.
কাজী জাফর আহমেদ,আব্দুল মান্নান ভূইয়া,তরিকুল ইসলাম,আব্দুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা কিংবা রাশেদ খান মেননের মত তৎকালীন তুখোড় বাম নেতারাও ভাসানীর কাছ থেকে নিয়েছেন বাস্তব রাজনৈতিক দীক্ষা। মাওলানা ভাসানী কোনো তাত্ত্বিক ছিলেন না,তিনি ছিলেন প্র্যাকটিক্যাল।কৃষক শ্রমিক আর স্বাধীনতা কামী মানুষের মুক্তির স্পিরিটকে তিনি খুব ভালো ভাবে ধারণ করতে পেরেছিলেন।মানুষের অধিকারের কথা বলতে বলতেই একজন মাওলানা হয়ে উঠলেন এ অঞ্চলের মানুষের প্রতিবাদের শ্রেষ্ঠ কন্ঠস্বর।ভারতের ফারাক্কা বাধের বিরুদ্ধে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে মাওলানা ভাসানী যে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দিয়েছেন চীনের মাও সে তুংয়ের লং মার্চের পর সারা দুনিয়ায় এত আলোড়ন সৃষ্টিকারী লং মার্চ আর দ্বিতীয়টি হয়েছে কিনা তা একমাত্র ইতিহাসই তার মূল্যায়ন করতে পারে। ভাসানীর ফারাক্কা অভিমুখে লং মার্চের পরেই জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই ইস্যুটি আলোচিত হয়ে উঠে।একজন মাওলানা সেই দিন বুঝতে পেরেছিলেন ফারাক্কা সংকট সমাধানের জন্য কী করতে হবে।কী না।মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক দর্শন যদি গান্ধীবাদ হয়ে থাকে তাহলে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শনকেও আমি ভাসানীবাদ বলতে চাই।তাঁর “খামোশ”
চিৎকারেই ক্ষেপে উঠত জালিমের মসনদ!
চার.
যার কোন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ছিল না,রাজনৈতিক কঠিন তত্ত্বের জগতেও যার কোনো পদচারনা ছিলনা তিনিই হয়ে উঠলেন এক অসাধারণ নেতা।তিনি আসামের কুখ্যাত লাইন প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, ভাসান চরের ঐতিহাসিক ভাসনেই তাকে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী থেকে মাওলানা ভাসানীর জায়গায় নিয়ে গেল।যে জায়গা শ্রদ্ধা সম্মান আর ভালবাসার।মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা থাকলেও স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি রাষ্ট্রপতি,প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এমপির কিছুই ছিলেন না,ক্ষমতার রাজনীতি তাঁকে নুন্যতম স্পর্শ করতে পারে নাই।অথচ আওয়ামীলীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই বিএনপির সময়ে করা ঢাকার মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী নভোথিয়েটার হয়ে গেল বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার?রাজনীতি যখন এক শ্রেণীর মানুষের রুটি রুজি ব্যবসা বাণিজ্য লুটপাট দখলের লাভজনক বিনিয়োগে পরিনত মাওলানা ভাসানী তখনই এগুলোকে “না” বলে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান।সাহস যোগান,আপোষ না করার শক্তি দেন,প্রেরণা হয়ে পথ দেখান।চাইলেই অনেক কিছু করতে পারতেন অথচ কী বেদনাদায়ক জীবন যাপনই না তিনি করেছেন!আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যে দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সেই দলই আজ তাকে ভুলে গেছে,তাঁর জন্ম -মৃত্যু বার্ষিকীটাও পালন করার প্রয়োজন মনে করে না তারা!হায় রাজনীতি!
পাঁচ.
মাওলানা ভাসানী ন্যাপের জন্য যে ধানের শীষকে মুক্তির প্রতীক হিসাবে বেছে নিয়ে ছিলেন তা আজ বিএনপির হাতে।ধানের শীষ আজ গনতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রতীক।মুক্তির প্রতীক।রাজনীতি যখন মানুষের কথা বলে তখন মানুষও সেই রাজনীতির পাশে এসে দাঁড়ায়।বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সবচেয়ে বড় প্রয়োজন তরুণ প্রজন্মের মাঝে শর্তহীন দেশপ্রেম ও আদর্শিক রাজনীতির চর্চা।যারা জনগনের বাংলাদেশ বিনির্মানের রাজনীতি করতে চান মাওলানা ভাসানী আজো হতে পারেন তাদের জন্য প্রেরণার অন্যতম উৎস।একজন রাজনীতিবিদের কাজ শুধু সব সময় ক্ষমতায় থাকাই নয়।অন্যায়,অবিচার আর জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই একজন সাধারণ মানুষকে অসাধারণ নেতায় পরিণত করে।ক্ষমতার রাজনীতির বাইরে থেকেও যে মানুষের জন্য কিছু করা যায় -মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।রাজনীতি যে কোনো লাভজনক ব্যবসা নয়,সমাজে সবচেয়ে বড় সোশাল সার্ভিস -এটা বুঝতেই মাওলানা ভাসানীকে পাঠ করতে হবে।
আজকের তরুণরা রাজনীতি নিয়ে হতাশ।সমাজের প্রতিটা জায়গায় আজ বিরাজনীতিকরণের মহা উৎসব চলছে।আদর্শহীন রাজনীতির চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়া কোটি তারুণ্যের সামনে যুগে যুগেই মাওলানা ভাসানী এমন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত-যাকে অনুসরণ করা যায়।
লেখক :রাজনৈতিক বিশ্লেষক