বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারির জন্ম দেওয়া ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বর্তমানে উচ্চ খেলাপিতে ধুঁকছে এমন ব্যাংকের সংখ্যা প্রায় ১৮টি। এসব ব্যাংকের প্রায় ১০ থেকে ৯৮ শতাংশ ঋণ এখন খেলাপি। এর মধ্যে অন্তত ৮টি ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে শিগগিরই এসব ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। এ ছাড়া যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তাদের মূলধন ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
দেশের ব্যাংক খাতে গত একযুগে বেশকিছু বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট, এসএ গ্রুপ, নূরজাহান, অলটেক্স, সানমুন গ্রুপ ও বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি। এসব ঘটনায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকারও বেশি বের করে নেওয়া হয়েছে। সুদসহ যার পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই টাকার পুরোটাই এখন খেলাপি। ব্যাংক এবং গ্রাহক উভয়ের যোগসাজশেই এসব অনিয়ম ও জালিয়াতি হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে দীর্ঘসময়ে ঋণের টাকা আদায় করা সম্ভব হয়নি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে উচ্চ খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে উল্লেখ করে তা কমানোর উদ্যোগ ও পরিকল্পনা জানতে চায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে দ্রুত বিভিন্ন আইন সংশোধন করার পাশাপাশি আর্থিক খাত সংস্কার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
বিভিন্ন ছাড়ের পরও ব্যাংক খাতে লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ সর্বশেষ ত্রৈমাসিক ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এ তিন মাসে নতুন করে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার ১৩৮ কোটি
টাকা। সব মিলিয়ে সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য মন্দ মানে পরিণত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৮ শতাংশের চেয়ে বেশি।
উচ্চ খেলাপি ঋণ ১৮ ব্যাংকে : খেলাপি ঋণের বড় অংশই রয়েছে সরকারি-বেসরকারি ১৭ ব্যাংকে। এর মধ্যে বিদেশি মালিকানাধীন ব্যাংকও রয়েছে। এ তালিকায় আছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ৬টি, বিশেষায়িত ৩টি, বেসরকারি ৭টি ও বিদেশি ২টি। এসব ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ রয়েছে বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৯৭ দশমিক ৯০ শতাংশই খেলাপি। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের বড় টাকাই আটকে আছে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। এর মধ্যে ঢাকেশ্বরী হায়েটস, কটন গ্রুপ, ইব্রাহিম টেক্সটাইল, ডিজি নিটিং, এসবি ট্রেডাস, ওয়ার্ল্ড টেল বিডি, আলেয়া সোয়েটার, টেক্সটাইল ভারসুসোর ও বিআই এন্টারপ্রাইজ অন্যতম।
উচ্চ খেলাপি ঋণের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এ ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ৮৩ শতাংশের বেশি খেলাপি। ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামে কার্যক্রম পরিচালনাকালে ২০০৬ সালে সীমাহীন ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছিল এ ব্যাংকটিতে।
নানা আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্ম দেওয়া চতুর্থ প্রজন্মর পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৬৭ শতাংশ। ব্যাংকটির বিতরণ করা ৫ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকার মধ্যে ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকাই খেলাপি।
ঋণ জালিয়াতির কারণে উচ্চ খেলাপিতে ধুঁকছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। এ ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়। আলোচিত এই ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িতদের বেশির ভাগই এখনো আইনের আওতায় আসেনি। বর্তমানে এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা বা ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ।
গত ১০ বছরে জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট, নূর জাহানসহ অন্যান্য গ্রুপ মিলে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে। ফলে এ ব্যাংকটিতেও খেলাপি ঋণের আধিক্য বিরাজ করছে। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
সোনালী ব্যাংক থেকে যোগসাজশ ও জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্ক গ্রুপ নিয়ে গেছে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। এই টাকাও দীর্ঘদিনে ফেরত আসেনি। এখনো হলমার্কের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে সোনালী ব্যাংক। গত সেপ্টেম্বর শেষে এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ।
বিভিন্ন সময়ে ঋণ বিতরণে অনিয়ম করেছে অগ্রণী ব্যাংকও। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে উঠে আসে অগ্রণী ব্যাংকের ১৯টি শাখা থেকে ২৬টি প্রতিষ্ঠানকে ঋণের নামে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা দেওয়ার তথ্য। পরে আরও ঋণ অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসে। কিন্তু ওই অর্থ আদায় হয়নি। ফলে এ ব্যাংকেও খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। গত সেপ্টেম্বরে তা দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) থেকেও ঋণের নামে প্রচুর টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। এ তালিকায় আছে চট্টগ্রামভিত্তিক মোস্তফা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এমএম ভেজিটেবল অয়েল, ঢাকা ট্রেডিং হাউস, টিআর স্পেশালাইজড কোল্ডস্টোরেজ, নর্থ বেঙ্গল এগ্রো ও নর্থ বেঙ্গল হ্যাচারি, টাটকা এগ্রো ও মুন্নু ফ্রেব্রিক্স অন্যতম। এ ব্যাংকেরও বিতরণ করা ঋণের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এখন খেলাপি। গত সেপ্টেম্বরে যা দাঁড়িয়েছে ৮৪৭ কোটি টাকা বা ৪০ দশমিক ৭২ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। বর্তমানে এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ। বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকেও খেলাপি ঋণের আধিক্য বেশি। গত সেপ্টেম্বর শেষে এ দুটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯ দশমিক ২৭ শতাংশ ও ২১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এ খাতের অপর ব্যাংক প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ ঋণ।
ঋণ বিতরণে বড় ধরনের অনিয়ম ও জালিয়াতি হয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকেও। ফলে এ ব্যাংকেও খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে যা দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। খেলাপি ঋণ বেশি থাকা অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের এক হাজার ৫৩ কোটি টাকা বা ৪৫ দশমিক ৪২ শতাংশ, এবি ব্যাংকের ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংকের ২ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং উত্তরা ব্যাংকের ১ হাজার ৪৪১ কোটি বা ৯ দশনিক ৫২ শতাংশ। এ ছাড়া বিদেশি খাতের হাবিব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ ৮ ব্যাংক : খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় পুরো ব্যাংকিং খাতই প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে একটিরই ঘাটতি প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘাটতি হয়েছে ৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা বেসিক ব্যাংকে। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংকে ৩ হাজার ৫২১ কোটি, রূপালী ব্যাংকে ৩ হাজার ১৩ কোটি, জনতা ব্যাংকে ৫৯৮ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ৩৪৫ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে ১৭১ কোটি ও স্টান্ডার্ড ব্যাংকে ৩৪৭ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে।