ঢাকাশুক্রবার, ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মানুষের গায়ে হাত দিলে রক্ষা নেই

নিউজ ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
নভেম্বর ৭, ২০২২ ১২:০২ অপরাহ্ণ
Link Copied!

বিএনপি-জামায়াত জোটের অগ্নিসন্ত্রাস ও বর্বরতার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ওই দুঃসময়ের কথা কেউ যেন ভুলে না যায়। সেই দিন যেন আর ফিরে না আসে, সে জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

তিনি বলেন, ‘কেউ রাজনীতি করতে চাইলে সুষ্ঠু রাজনীতি করুক। আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের গায়ে কেউ হাত দিলে তাদের রক্ষা নেই। এটা সহ্য করা যায় না। কোনো মানুষ সহ্য করতে পারবে না। ’

গতকাল রবিবার সকালে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে ‘অগ্নিসন্ত্রাসের আর্তনাদ : বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খণ্ডচিত্র’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে আওয়ামী লীগ।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন কর্মসূচির সময়ে সহিংসতার শিকার এবং জিয়াউর রহমানের আমলে হত্যাকাণ্ডের শিকার সামরিক বাহিনীর পরিবারের কয়েকজন সদস্য বক্তব্য দেন। তাঁরা নিজেদের জীবনের দুর্বিষহ নানা অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

আগুন সন্ত্রাসে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি তাদের পাশে দাঁড়াতে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা যতটুকু পারি, করেছি। কিন্তু যে মানুষগুলো আপনজন হারিয়েছে, তাদের ব্যথা, কষ্ট ও বেদনা তো দূর করা সম্ভব নয়। আগুনে পুড়ে অনেকের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ওই দুঃসময়ের কথা যেন কেউ ভুলে না যায়। ’

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভবিষ্যতে অগ্নিসন্ত্রাসের মতো ঘটনা যাতে না ঘটে এ জন্য দেশবাসীকে সজাগ থাকতে হবে। এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে কেউ ঘটাতে না পারে। যারা ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারে ও কষ্ট দিতে পারে, তাদের পাশে মানুষ কিভাবে দাঁড়ায়, আমি জানি না। কিভাবে সমর্থন করে?’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই। দেশের উন্নতি ও মানুষের কল্যাণ চাই। ’ দেশের প্রত্যেকটা মানুষের স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেই অধিকার সংরক্ষণ করার চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। ’

২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন কর্মসূচিতে সহিংসতার কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, কিভাবে মানুষ মারে? একটা গাড়িতে যাচ্ছে জীবন্ত মানুষগুলো। সেখানে আগুন ধরিয়ে মানুষকে হত্যা করা। কিভাবে মানুষ পারে মানুষের ক্ষতি করতে? এটাই নাকি আন্দোলন! এই আন্দোলন তো আমরা কখনো দেখিনি। ’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘সামরিক শাসক আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান ও জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের রাজপথে আন্দোলন করেছি। আমরা তো এই কথা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। পেট্রল বোমা দিয়ে অথবা অগ্নিসন্ত্রাস করে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। সেটা আন্দোলন?’

তিনি বলেন, বিএনপি ঘোষণা দিল অবরোধ ও হরতাল। কিন্তু কাজ হলো মানুষকে হত্যা করা। আজ এখানে যারা উপস্থিত তারা তো সামান্য কয়েকজন। ২০১৩ সালে তিন হাজার ৬০০ জনের মতো মানুষকে পেট্রল বোমা মেরে আহত করেছে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালেও করেছে। একইভাবে গাড়ি পুড়িয়ে মানুষের জীবন-জীবিকা শেষ করে দিয়েছিল। এটা কী রকম আন্দোলন। সেটাও জানি না। আন্দোলন, মানুষের অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে মানুষকে নিয়েই তো আন্দোলন করতে হয়। কিন্তু তারা আক্রমণ চালিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আন্দোলনের নামে প্রায় ৫০০ জন মানুষ আগুনে পুড়ে মারা গেছে এবং সাড়ে তিন হাজার মানুষ আহত হয়েছিল। মানুষের কান্না, যন্ত্রণা ও বেদনা আজ দেখেছি। আমি স্বজনহারা, এক দিনে বাবা, মা, ভাই—সব হারিয়েছিলাম। এদের কষ্টটা আমি উপলব্ধি করতে পারি। ’

বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনে সহিংসতার বিচার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিচার বোধ হয় আল্লাহর তরফ থেকেই হবে। হয়তো প্রত্যেক মামলার বিচার চলছে না। কিন্তু যারা অগ্নিসন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে। বিচারের কাজ চলছে। অনেকেই শাস্তি পাচ্ছে। ভবিষ্যতেও পাবে। কিন্তু যারা হুকুমদাত্রী বা হুকুমদাতা, তাদের কথাও আপনারা ভেবে দেখেন। ’

ভুক্তভোগীদের কথা শুনে কাঁদলেন প্রধানমন্ত্রী

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। শুরুতে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের কর্মসূচিতে সহিংসতার নানা তথ্য ও ভিডিও চিত্র তুলে ধরা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে গিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর আসনে গিয়ে বসলে শুরু হয় ভুক্তভোগীদের বক্তব্য। তাঁদের কেউ বাবা হারিয়েছেন, কেউ সন্তান, কেউ স্বামী। তাঁরা কথা বলতে গিয়ে কেউই অশ্রুসংবরণ করতে পারেননি। তাঁদের কান্না ছুঁয়ে যায় শেখ হাসিনাকেও। ভুক্তভোগীদের বক্তব্যের সময় বারবার প্রধানমন্ত্রীকে চোখ মুছতে দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সময়ও তাঁকে আবেগাপ্লুত দেখা যায়।

২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর শাহবাগে বাসে আগুন ধরিয়ে দিলে পুড়ে মারা যায় ১৭ বছরের কিশোর নাহিদ। তার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা রুনি বেগম। তিনি বলেন, ‘শাহবাগে আমার সন্তানকে বিএনপি-জামায়াত পেট্রল বোমা মেরে হত্যা করে। আমার সন্তানকে দেখতেও পারি নাই। আমার সন্তানের লাশও দেখার সুযোগ দেয় নাই। তার কারণে আজও আমি অসুস্থ। সেই ঘটনায় আমি বিচার পাই নাই। প্রধানমন্ত্রী আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই। ’

গাজীপুরে কাভার্ড ভ্যানে পেট্রল বোমা হামলায় আগুনে পুড়ে মারা যায় মনির হোসেন। তার বাবা রমজান আলী বলেন, ‘আমি তো কোনো রাজনীতি করি না। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। আমার চোখের সামনে, ছোট ছেলেটাকে তারা আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল, কিন্তু আমি বাঁচাতে পারলাম না। এর চেয়ে কষ্ট পৃথিবীতে কোথাও নাই। ’

বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন কর্মসূচির দিনে কাঁচপুরে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বিজিবির সুবেদার নায়েক শাহে আলমকে। তাঁর স্ত্রী নাসরিন আক্তার আলেয়া বলেন, ‘আমার স্বামীকে কর্মরত অবস্থায় পিটিয়ে হত্যা করেছে। এরা মানুষ না জানোয়ার, তা শুধু তারাই বলতে পারবে। আমার সন্তানরা তাদের বাবা হারানোর ব্যথা কোনো দিন ভুলতে পারবে না। ’

২০১৩ সালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বাসে আগুন দেওয়া হলে এলিফ্যান্ট রোডের দোকান কর্মচারী সালাউদ্দিন ভূইয়ার পুরো শরীর পুড়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আমি খুব সুখী ছিলাম। চেহারা সুন্দর ছিল। যেখানে ইন্টারভিউ দিতাম, চাকরি হতো। কিন্তু আগুনে পুড়ে আমার চেহারা বিকৃত হওয়ার পরে কেউ চাকরি দিতে চায় না। আমার কাজ করার শক্তি আছে, কিন্তু কেউ কাজ দেয় না। ’

রাজধানীর কাঁচপুরে নিহত পুলিশ কনস্টেবল জাকারিয়ার স্ত্রী মায়া বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী গোপালগঞ্জে চাকরি করত। সেখান থেকে কাঁচপুর এলে হেফাজত বাহিনীরা আমার স্বামীরে হত্যা করেছে। এর বিচার আমি চাই। ’

২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামে বিএনপি-জামায়াতের হামলায় আহত হন আলোকচিত্র সাংবাদিক আবু সাঈদ তামান্না। তিনি বলেন, ‘রাজনীতিটা প্রতিযোগিতামূলক ও সুন্দর হবে। সেটাই আমরা চাই। রাজনীতির নামে মানুষকে মারবে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা বিচার চাই। ’

২০১৩ সালের মার্চে রাজশাহীর সাহেববাজারে বোমা হামলায় আহত পুলিশের এসআই মকবুল হোসেন বলেন, ‘জামায়াত-শিবিরের নিক্ষিপ্ত বোমায় আমার দুটি হাত হারিয়ে ফেলি। আমি আহত হয়েছি, পঙ্গু হয়েছি। কিন্তু মনোবল হারাইনি। কিন্তু এখনো জামায়াত-শিবিরের কথিত সাংবাদিক প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নামে-বেনামে আমার বিরুদ্ধে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে দরখাস্ত দিয়ে আমার পদোন্নতি আটকে দিয়েছে। জামায়াতের বিভিন্ন সাংবাদিক পুলিশের মনোবল নষ্ট করতে ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু আমরা মানুষের জানমাল রক্ষায় জীবন দিতেও প্রস্তুত। ’