দেশের নিম্ন আয়ের ৪২ শতাংশ পরিবারের আয় গত ছয় মাসে কমে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে সিলেট বিভাগে। খাদ্য, স্বাস্থ্য ও জ্বালানির ব্যয় বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দারিদ্র্য বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ফলে টিকে থাকতে প্রায় ৫৫ শতাংশ পরিবার ঋণ নিচ্ছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) ‘বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছয় মাসের ব্যবধানে সিলেটের ৫৭ শতাংশ ভাগ নিম্ন আয়ের পরিবারের আয় কমে গেছে। এ ছাড়া বরিশালের ২৬ শতাংশ এবং সিলেটের ৩৫ শতাংশ পরিবার মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এ দুটি বিভাগে আর্থিক ও খাদ্য সংকট বৃদ্ধির কারণে সঞ্চয় ভাঙার চাপে রয়েছে ৭৫ শতাংশ পরিবার। সব মিলিয়ে দেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ পরিবার খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। এ ছাড়া সামুদ্রিক খাবারসহ পুষ্টিকর উপাদান সমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে না ৮৩ শতাংশ পরিবার।
দেশে দারিদ্র্য বৃদ্ধির ঝুঁকিপূর্ণ এই পরিস্থিতির মধ্যেই আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে—সবার জন্য সমান মর্যাদা কার্যকর করা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশেষ পরিস্থিতির কারণে দেশে যেসব মানুষ নতুন করে দরিদ্র হচ্ছে, তাদের স্বীকার করে নিয়ে বিশেষ কার্যক্রমের মাধ্যমে উদ্ধার কর্মসূচি নিতে হবে। খাদ্য দারিদ্র্য বিমোচনে জাতীয় ত্রাণ তহবিল গঠন করতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে আরো সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। বয়স্কদের জন্য প্রথাগত উদ্যোগের পাশাপাশি নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচনে যেসব কার্যক্রম বা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মূল্যায়নও জরুরি। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঢেলে সাজাতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে আরো কিভাবে দক্ষ করা যায়, সে উদ্যোগ প্রয়োজন।
ডাব্লিউএফপি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরির জন্য গত ছয় মাসে পরিবারগুলোর ওপর বড় কী ধরনের অভিঘাত এসেছে, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। এক হাজার ২০০ মানুষের মতামতের ওপর ভিত্তি করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। গত মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে আটটি বিভাগের এসব মানুষের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেখানে ৮৮ শতাংশ মানুষ খাদ্যের চড়া দামকে বড় আঘাত হিসেবে উল্লেখ করেছে। আরো তিনটি বিষয় বড় আঘাত হিসেবে উঠে এসেছে—রোগ ও চিকিৎসা ব্যয়, তেলের দাম ও পরিবহন ব্যয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপ সবচেয়ে বেশি মনে করছে চট্টগ্রাম বিভাগের মানুষ। এই বিভাগের ৯৩ শতাংশ পরিবার খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপে আছে বলে জানায়। এ ছাড়া বরিশালের ৯১ শতাংশ ও খুলনার ৮৯ শতাংশ পরিবার চাপ মনে করছে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আগস্ট মাসে নিম্ন আয়ের ৪২ শতাংশ পরিবারের আয় কমে যাওয়ার কারণে জীবনযাত্রা ও খাদ্য পরিস্থিতির সব ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। এর মধ্যে ৩ শতাংশ পরিবারের আয় বিপজ্জনক মাত্রায় কমেছে; উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে ১৮ শতাংশ পরিবারের এবং সামান্য পরিমাণে কমেছে ২১ শতাংশ পরিবারের।
সিলেট বিভাগে পরিবারগুলোর আয় বেশি কমেছে। এই বিভাগের প্রায় ৫৭ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। এর পরেই রয়েছে খুলনা বিভাগ। সেখানে ৪৬ শতাংশ এবং বরিশাল বিভাগের ৪৫ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে। মূলত খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে বহুমুখী মূল্যবৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগবালাইয়ের প্রকোপ বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধিকেই দায়ী করছেন জরিপে অংশগ্রহণকারীরা। এই ব্যয় মেটাতে আগস্ট মাসে খাদ্য কেনার জন্য ৪৪ শতাংশ পরিবার ঋণ নিয়েছে। নগদ অর্থ ধার করেছে ১১ শতাংশ পরিবার। ফলে ঋণগ্রস্ত হচ্ছে ৫৫ শতাংশ পরিবার।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০১৯ সালের পর থেকে দারিদ্র্যের তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। নতুন দরিদ্র তৈরি হচ্ছে, সেটাকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সামগ্রক নীতি ও কার্যক্রমে দারিদ্র্য বিমোচনে দক্ষতার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এখন জরুরি ভিত্তিতে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। খাদ্য দারিদ্র্য কমাতে স্বল্প মূল্যে খাদ্য বিতরণের আওতা বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে দক্ষতা আনতে হবে।