ঢাকারবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

সরকারি বাসভবনে একসাথে ফ্রিতে থাকেন আ.লীগ-বিএনপি নেতারা

নিউজ ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
অক্টোবর ১৫, ২০২২ ৫:১৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

দৈনিক বাংলার প্রতিবেদন

রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল হক। একই সঙ্গে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও। এই জনপ্রতিনিধি ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কর্ণফুলী পেপার মিলস (কেপিএম) লিমিটেডের বন ভবন-২-এর পূর্ব পাশের বাসাটি ভাড়া নেন। তার সঙ্গে কেপিএমের চুক্তির প্রথম শর্তই ছিল প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে।

 

কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী মফিজুল ভাড়া পরিশোধ করে আসেননি বলে অভিযোগ তুলেছে কেপিএম কর্তৃপক্ষ। ভাড়ার বকেয়া জমতে জমতে গত এক দশকে তার কাছে কেপিএমের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৫৭৫ টাকা। বকেয়া টাকা চেয়ে ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০ বার নোটিশ দেয়া হয় মফিজুলকে। অথচ বকেয়া পরিশোধ ছাড়াই উল্টো তিনি কোনো কিছু না জানিয়ে এক বছর আগে বাসা ছেড়েছেন বলে দাবি করেছে কেপিএম।

 

একই উপজেলা পরিষদের সাবেক নারী ভাইস চেয়ারম্যান নুর নাহার বেগম। তিনি বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের রাঙামাটি জেলা শাখার জ্যেষ্ঠ সহসভাপতিও। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১১ সালের শুরুতে কেপিএমের বন বিভাগ-২-এর পশ্চিম অংশটি বরাদ্দ পান নুর নাহার। তিনিও পরিশোধ করেননি বাসা ভাড়া। তার কাছে কেপিএমের পাওনা ১০ লাখ ২১ হাজার ২৫ টাকা। বকেয়া আদায়ে গত ৮ বছরে তাকে ১৯ বার নোটিশ দিয়েছে কেপিএম কর্তৃপক্ষ। কেবল জনপ্রতিনিধি থাকাকালীন পর্যন্ত বাসাটি ব্যবহারের শর্ত থাকলেও সেটি মানছেন না তিনি। এখনো পরিবার নিয়ে থাকছেন বাসাটিতে।

 

শুধু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জেলা পর্যায়ের এই দুই শীর্ষ নেতাই নন, কেপিএমের আবাসিক ভবনগুলোর বাসায় থাকলেও ভাড়া পরিশোধ করেন না অনেকেই। সম্প্রতি কেপিএম কর্তৃপক্ষ এমন শতাধিক ব্যক্তিকে চিঠি দিয়ে বকেয়া পরিশোধ করার নির্দেশ দিয়েছে। তাদের কাছে কেপিএমের পাওনা কোটি টাকার ওপর।

 

প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা কাজী মোশাররফ হোসেনের সই করা এসব নোটিশে দ্রুত বকেয়া পরিশোধ না করলে বাসার পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়।

 

এর মধ্যে ৬৬ জনকে দেয়া নোটিশের কপি দৈনিক বাংলার এ প্রতিবেদকের কাছে আছে। এসব নোটিশ পর্যালোচনায় দেখা যায়, কেপিএমের সরকারি বাসায় থেকেও ভাড়া পরিশোধ না করাদের বড় অংশই জনপ্রতিনিধি। এই তালিকায় আরও আছেন কেপিএমের সাবেক শ্রমিক-কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী থেকে স্কুলশিক্ষকও।

 

রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা এলাকায় ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কেপিএম। শুরু থেকেই কাগজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হতো প্রতিষ্ঠানটির নাম। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রায়ত্ত কাগজ কলটি প্রায় ডুবতে বসেছে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) আওতাধীন প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ লাভের মুখ দেখে তাও ১৪ বছর আগে, ২০০৮ সালে। এখন এক প্রকার বন্ধই আছে প্রতিষ্ঠানটি। পাঁচ হাজার শ্রমিকের মধ্যে এখন আছেন ৫০০ জনের মতো।

 

কেপিএমের কর্মকর্তা-শ্রমিকদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি যে অনেকটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তার অন্যতম একটি কারণ, ভাড়া না দিয়ে বাসা দখল করে রাখা। তাদের মতে, এর ফলে সরকার একদিকে ভাড়া পাচ্ছে না, আবার প্রতিষ্ঠানের সম্পদও (বাসা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি) অপচয় হচ্ছে।

 

আরও যারা ভাড়া দেন না

 

উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে কেপিএমের পাওনা আছে ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৮২৫ টাকা। তিনি বন ভবন-৩-এর নিচতলায় থাকছেন। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত বকেয়া আদায়ে তাকে সাতবার নোটিশ দেয়া হলেও তিনি গা করেননি।

 

উপজেলা যুবলীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক ও চন্দ্রঘোনা ইউপির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য আবুল হাসনাত খোকন ২০১৮ সাল থেকে ইঞ্জিনিয়ার কলোনির একটি বাসায় থাকলেও ভাড়া পরিশোধ করছেন না। তার কাছে কেপিএমের পাওনা ২ লাখ ১৮ হাজার ১২৫ টাকা।

 

ইউপির সাবেক নারী সদস্য ফুসকারা বেগমও ভাড়া পরিশোধ করছেন না। তার কাছে কেপিএম পাবে ১ লাখ ৩ হাজার ৫৫ টাকা। ভাড়া পরিশোধ করছেন না আওয়ামী লীগ নেতা ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আলী এরশাদ। তার কাছে বকেয়া আছে ৫৯ হাজার ২৯২ টাকা।

 

অন্যদিকে চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য মো. আজিজুল হক দখল করে আছেন কয়লার ডিপো এলাকার একটি বাসা। তাকে দ্রুত বাসা ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হলেও তিনি ছাড়েননি। একইভাবে বাসা দখল করে রেখেছেন সাবেক ইউপি সদস্য নয়ন বেগম, মো. মাইনুল ইসলাম।

 

বেশ কিছু শিক্ষকও কেপিএমের বাসায় থাকলেও ভাড়া দিচ্ছেন না। তাদের মধ্যে বারঘোনিয়া মুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিক শামিমা আক্তারের কাছে ২ লাখ ৮ হাজার ৭২৫ টাকা, ডলুছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বিলকিস সুলতানার কাছে ২ লাখ ৯ হাজার ৬২৫, কে আর সি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুল ইসলামের কাছে ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা পাবে কেপিএম।

 

জানতে চাইলে কাপ্তাই উপজেলা চেয়ারম্যান মফিজুল হক অভিযোগ করেন, কেপিএম তাকে অতিরিক্ত বিল ধরিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি ২০২১ সালের জুনে বাসা ছাড়লেও এখন পর্যন্ত বাসা ভাড়া দাবি করছে। আমি বকেয়ার এই হিসাব সংশোধনের জন্য আবেদন করেছি। একই সঙ্গে ভাড়াও দিয়ে যাচ্ছি।’

 

মফিজুল আরও বলেন, ‘বিসিআইসির আইনে বাসা ভাড়া দেয়ার নিয়ম নেই। বিষয়টি আমরা আগে না জানলেও এখন জেনেছি। আমার জানামতে, এখন সেখানে আমাদের দলের ১০-১২ জনসহ বিভিন্ন দলের অনেকে পরিবার নিয়ে থাকছে।’

 

কেপিএম ভুতুড়ে বিল ধরিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করেন নুর নাহার বেগমও। তিনি বলেন, ‘২০১১ সালে পরিত্যক্ত বাসা মেরামতসাপেক্ষে আমাদের এখানে থাকতে দেয়া হয়েছে। আর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মূলত ২০১৭ সালে। বিসিআইসির আইনে যেহেতু বরাদ্দের নিয়ম নেই, তাই কাগজপত্রও নেই। বকেয়া বিলের বিষয়ে আপত্তি আছে। এ বিষয়ে কেপিএমের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তারা আমাদের কথা শুনতে চান না।’

 

অন্যদিকে চন্দ্রঘোনার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরীর দাবি, কেপিএম হয়রানি করার জন্য অতিরিক্ত ঘর ভাড়া দাবি করছে।

 

চাপে পড়ে বাসা ভাড়া দিয়ে আরও চাপে

 

মূলত কেপিএমের শ্রমিক-কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের আবাসনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল সেখানকার আবাসিক ভবনগুলো। কিন্তু হাতের নাগালে গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানিসমৃদ্ধ এসব ভবনে বাসা পেতে অনেকটাই মরিয়া হয়ে ওঠেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তারা নানাভাবে কেপিএমের ওপর চাপও তৈরি করতে থাকেন। বাধ্য হয়ে একসময় বিসিআইসির নিয়ম ভেঙে এক যুগ আগে তাদের বাসা ভাড়া দেয় কেপিএম কর্তৃপক্ষ। কেপিএমের ৩০০ বাসার মধ্যে ১০০ বাসা বর্তমানের প্রতিষ্ঠানের বাইরের ব্যক্তিদের নামে বরাদ্দ দেয়া। জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রভাবশালী ও বদলি হয়ে যাওয়া শ্রমিক-কর্মকর্তাদের পরিবার এসব বাসায় থাকছে। কিন্তু তাদের কাছে বাসা ভাড়া দেয়াটাই এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে কেপিএম কর্তৃপক্ষের কাছে।

 

কেপিএমের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পাওনা আদায়ে যখনই কেপিএম উদ্যোগী হয়েছে, তখনই রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীরা উল্টো কারখানার পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছেন। এখন বকেয়া পরিশোধের নোটিশ দেয়ার পরও তারা সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’

 

জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের তোপের মুখে পড়ার ভয়ে এ নিয়ে কথা বলতে চাননি কেপিএমের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আনোয়ার হোসেন। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বকেয়া আদায়ে সবাইকে নোটিশ দেয়া হয়েছে। তবে এর বেশি আমি বলতে পারব না।’

 

কেপিএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সুদীপ মজুমদারকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। এমনকি খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।