গতকাল দেশ ছিল দাস, কিন্তু সাংবাদিক স্বাধীন, কিন্তু আজ দেশ স্বাধীন, সাংবাদিক দাস। দেশে যখন দাসপ্রথা আইন ছিল, তখন সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনগণই শুরু করে বিপ্লব সৃষ্টির কাজ। আজ যখন আমাদের দেশ স্বাধীন, তখন আমাদের কথাগুলো দাসে পরিণত হয়েছে। গতকাল একজন সাংবাদিক লিখতে বসলে কলম থেমে থাকেনি, কিন্তু আজ সাংবাদিক নিজেই লিখতে গিয়ে থেমে যায় কারণ আগে সাংবাদিকরা অপরিচিত কাউকে যতটা ভয় পেত না, আজ তাদের প্রিয়জনকে বেশি ভয় পায়।
এই দেশ ব্রিটিশ শাসিত, পাকিস্তান শাসিত। একটা সময় কলম-কাগজের মাধ্যমে কলমের সৈনিকরা দাসত্ব কাকে বলে এবং কীভাবে মানুষ তা থেকে মুক্তি পাবে তা জনগণকে বলে দিতেন। কিন্তু আজ সরকার বা ব্যবস্থাপনার কোনো সমস্যা হলে তার বিরুদ্ধে কেউ আওয়াজ তুলতে পারে না এবং চেষ্টা করে ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে সামনে রেখে কলমের শক্তি কেনা যায় কিনা। আগে মানুষ সাংবাদিকতার শখের সঙ্গে যুক্ত হলেও আজ সেই শখই প্রয়োজনে রূপ নিয়েছে এবং এটা একটি ব্যবসার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। আজ যখন একজন আবেগপ্রবণ সাংবাদিক কোনো সংবাদ নিজ চেষ্টায় বের করে, তখন সেই খবর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও অন্যদের কাছে চলে যায় এবং সময়ের পরিক্রমায় তা মরে যায় বা মুনাফা লাভের তাগিদে চাপা পড়ে যায়।
সাংবাদিকতার এই পরিবর্তনশীল প্রকৃতির জন্য শুধু সাংবাদিকের চরিত্র ও চাহিদাই দায়ী নয়, এর জন্য দায়ী আমাদের পাঠকরাও। যা এই পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে এতটাই পরিবর্তিত হয়েছে যে এটি একজন কলমবীদের অনুভূতি থেকে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের কথাকে আলাদা করে দিয়েছে। এর ফল আজ সাংবাদিক নিজের ইচ্ছায় কিছু লিখতে পারে না কারণ সে তার পাঠকের দাস এবং তাকে লিখতে হয় তার পাঠক যা চায়। তা ছাড়া একজন সাংবাদিকও যদি প্রাণবন্ততা দেখিয়ে সংবাদ থেকে বাস্তবতা তুলে ধরার মন স্থির করেন, তবে সেই সংবাদ পত্রিকার গোষ্ঠীর নীতিমালা এবং বিজ্ঞাপনের দরপত্র দিয়ে ডাস্টবিনে শোভা পায়। এই বিষয়গুলোকে ফিল্টার করে যদি সেই খবরটি ফিল্টার করে মৌলিক বিষয়গুলোর সাথে সংরক্ষিত করা হয়, তাহলে কোথাও সেই খবরটি পাতায় ছাপা যাবে।
বাজার ও ব্যবসার চাপে আজকের সাংবাদিকতা। যার কারণে গণমাধ্যম জনগণকে সচেতন করার ভিত্তি থেকে বের হয়ে এসে ব্যাপকভাবে পেইড নিউজের আবির্ভাব ঘটেছে। গণমাধ্যমে ‘পেইড নিউজ’-এর ক্রমবর্ধমান প্রবণতা শুধু দেশ ও সমাজের জন্যই নয়, সাংবাদিকতার জন্যও বিপজ্জনক। পেইড নিউজ কোনো রোগ নয়, রোগের লক্ষণ। এর উৎপত্তি অন্যত্র। এ দিকে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করা দরকার। মিডিয়া সমাজের একটি প্রভাবশালী অংশ হয়ে উঠেছে কিন্তু আজ এই স্তম্ভে পুঁজিবাদীদের প্রভাব বাড়ছে, যা দেশ ও সমাজের জন্য মারাত্মক।
আজকের মিডিয়া সমাজকে এতটাই প্রভাবিত করেছে যে, যে কাউকে রাজা অথবা সমপদমর্যাদার আসনে বসাতে পারে। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হল এত ক্ষমতা থাকার পরও মিডিয়াকে চারদিক থেকে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে কারণ এর উদ্দেশ্য চারদিক থেকেই বিভ্রান্তিকর বা বলা উচিত নেতিবাচকতাকে শুষে নিয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলির দিকে তাকালে বোঝা যায় নেতিবাচক সংবাদে মিডিয়ায় বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। এখানে গণমাধ্যমের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না, দেশের জনগণের কী জানার অধিকার আছে এবং গণমাধ্যমে দেখানো কোনো সংবাদকে কতটা প্রচার করা হবে, এই বিষয়টি বিবেচনা করার মতো। কারণ বেশিরভাগ মানুষের মনের বিষয়গুলো ক্ষণস্থায়ী এবং টিভি চ্যানেল বা ম্যাগাজিনে অবিলম্বে পড়ার কারণে। খুব কম লোকই থাকবে যারা কোনো ঘটনা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবে। এমতাবস্থায় মিডিয়ার দেখানো মিথ্যা বা অর্ধসত্য দেশবাসীর মনে-মনে ভুল ছাপ ফেলে।
বলতে গেলে সাংবাদিকতা দেশের চতুর্থ স্তম্ভ। বিচার বিভাগ, আইনসভা, নির্বাহী বিভাগের মতো দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলোর ওপর নজরদারি করার কাজ করা সংবাদপত্র আজ তার মূল কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সাংবাদিকতা, যা শুরুতে মিশনের অধীনে জনগণের মধ্যে তার ভূমিকা পালন করেছিল, সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনশীল পেশা হিসাবেও পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তনের এই কাল এখানেই থেমে থাকেনি, বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতার স্বরূপ আবির্ভূত হয়েছে কমিশন আকারে। এমতাবস্থায় আজকের সাংবাদিকতাকে কোনোভাবেই অতীতের মিশন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে দেখা ঠিক হবে না। পরিবর্তন প্রকৃতির নিয়ম এবং মিডিয়াও তা অনুসরণ করছে। সম্ভবত বর্তমানের পরিবর্তন এই যে সাংবাদিকরা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করে তাদের জাতীয়তাবাদী, কমিউনিস্ট বা অন্যান্য অংশে বিদেশী হিসাবে দেখা হয়।
বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতাকে যদি সংজ্ঞায়িত করতে হয়, তাহলে একে মানবিক সংবেদনশীলতা বিক্রির ধারাবাহিক ধারাকে জোরালোভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার একটি উদ্যোগ বলা যেতে পারে। সংবাদপত্র হোক বা নিউজ চ্যানেল, নিজেদের মধ্যে চলছে টিআরপির যুদ্ধ, যার কারণে সামাজিক উদ্বেগ বাদ দিয়ে শুধু সামাজিক বৈষম্যই বেড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে। ক্ষমতার অহংকার এবং স্ব-নিযুক্ত হওয়ার অনুভূতি আজ মিডিয়াকে সামাজিক নজরদারির পরিবর্তে বিচারকের ভূমিকা পালন করে বলে মনে হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের এই প্রবণতা পাঠকদের সংবাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। গণমাধ্যম এখন তথ্য না দিয়ে পাঠকদের মাঝে তাদের মতামত পরিবেশনে ব্যস্ত।