সাধারণত কারাগারের ভেতরে সব ধরনের কাজ কয়েদিদের দিয়ে করানো হয়। বিপরীতে কয়েদিদের পারিশ্রমিকও দেওয়া হয়। কিন্তু কেরানীগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে বাইরের ৫০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে কারা কর্তৃপক্ষের হিসাবেই উল্লেখ আছে। যদিও এই তিন কারাগারে সর্বোচ্চ ১৩ জনকে নিয়োগ দিতে পারে কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী, এক বছরে ১৩ জনের বেতন হয় ২৬ লাখ ২৭ হাজার ৪০ টাকা। সেখানে ৫০ জনের নিয়োগ দেখিয়ে বেতন বাবদ তোলা হয়েছে এক কোটি ২৬ লাখ ৭৯ হাজার ১৯০ টাকা। অর্থাৎ অতিরিক্ত খরচ তোলা হয়েছে এক কোটি ৫২ হাজার ১৫০ টাকা।
শুধু এটিই নয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে করা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেশের ১৩ কারাগারের ১৪৩ কোটি ৭৯ লাখ ৪০ হাজার ৮১৬ টাকার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
দেশের ১৩টি কারাগারে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় চার মাসের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এবং সরেজমিনে গিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে নিরীক্ষা অধিদপ্তরের একটি দল।
২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের সব কারাগারের জন্য উন্নয়ন ও মঞ্জুরি মিলিয়ে মোট বরাদ্দ ছিল এক হাজার ২৬ কোটি ১২ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৯০২ কোটি ৭৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৩ টাকা। তবে নিরীক্ষার আওতায় ছিল ২৬৫ কোটি ৬২ লাখ ৯৬ হাজার ১৬৯ টাকা। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ছয় ক্যাটাগরিতে অনিয়ম ও ৪৪ খাতে ১৪৩ কোটি ৭৯ লাখ ৪০ হাজার ৮১৬ টাকার দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় কারাগার কাশিমপুর-১, কেন্দ্রীয় কারাগার কাশিমপুর-২, মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার কাশিমপুর, গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রংপুর, রাজশাহী ও যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার এবং বরিশাল ও কক্সবাজার জেলা কারাগারে তদন্তের সময় ১৬৪টি আপত্তি তুলেছে নিরীক্ষা দল। এর মধ্যে ৩৫টি আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি ১২৯টি আপত্তির বিপরীতে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ও সন্তুষ্টিমূলক জবাব দিতে পারেনি কারা কর্তৃপক্ষ।
১৩ জনের জায়গায় ৫০ জন
কেরানীগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৩ জনের জায়গায় ৫০ জনের নিয়োগের বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আপত্তি তোলা হয়েছে। এই আপত্তির জবাবে সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, জেল কোড অনুযায়ী বন্দিদের দিয়ে কারাগারের কাজ করানোর কথা, কিন্তু বন্দিদের মধ্যে পরিচ্ছন্নতাকর্মী না পাওয়ায় ছয় মাস অন্তর অন্তর পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে কারা কর্তৃপক্ষের এমন জবাবে সন্তুষ্ট হয়নি নিরীক্ষা অধিদপ্তর। তাই আপত্তিটি নিষ্পত্তি হয়নি। উল্টো আপত্তির জবাবের বিপরীতে প্রতিবেদনে নিরীক্ষা মন্তব্যে বলা হয়, অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী জনবলের ঘাটতি থাকেই, কেবল জনবল নিয়োগ দিতে পারে কারা কর্তৃপক্ষ। তা-ও জেলখানার বাইরের জন্য। জেলের ভেতরের সব কাজ বন্দিদের দিয়েই করাতে হবে।
কারাগারের আয় কোথায় যায়
সরকারি টাকা খরচ করে কারাগারের ভেতরে ক্যান্টিন বসানো হয়েছে। এতে সরকারি স্থাপনা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, জনবল ব্যবহার করে ক্যান্টিন পরিচালনা করা হলেও ক্যান্টিনের আয় সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয় না। এতে ১৩ কারাগার মিলিয়ে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ছয় কোটি ৪৯ লাখ ২১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। তদন্তে ক্যান্টিনের এসব আয় সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার কোনো প্রমাণ পায়নি নিরীক্ষা দল।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের আপত্তির জবাবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, হোল্ডিং ট্যাক্স, গ্যাস ও বিদ্যুতের বিল মিটার বসানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্টিনের আয় থেকে জমা দেওয়া হবে। এ ছাড়া ক্যান্টিন সরকারের টাকায় পরিচালিত হয় না। তাই ক্যান্টিনের আয় সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়া হয় না।
তবে ক্যান্টিনের আয়ের টাকার মধ্যে কারা কর্মচারী পরিবার নিরাপত্তা প্রকল্পে ২৫ শতাংশ, কারা অধিদপ্তর ১৩ শতাংশ, কারা ক্রীড়া উন্নয়ন ফান্ডে ২ শতাংশ জমা দেওয়া হয়। বাকি ৬০ শতাংশ টাকার মধ্য থেকে কারা কর্মচারী কল্যাণে ৪০ শতাংশ ও কারাবন্দি কল্যাণে ২০ শতাংশ টাকা ব্যয় করা হয়।
আপত্তির জবাবের বিপরীতে নিরীক্ষা মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, কারা কর্মচারী ও বন্দি কল্যাণে ব্যয় করার কোনো নীতিমালা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নেই। আর এতে অর্থ মন্ত্রণালয়েরও অনুমোদন নেই। যদিও বাস্তবে কারাবন্দি কল্যাণে ব্যয়ের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া ক্যান্টিনে রান্নার কাজে ব্যবহৃত জ্বালানি গ্যাসের বিল পরিশোধ না করায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৬৮ লাখ ৫৬ হাজার ৭৯২ টাকা। আর কারাগারের বিভিন্ন সম্পত্তি ইজারা দিয়ে পাওয়া ৮৭ লাখ ৬৯ হাজার ১৬৯ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি। আবার কয়েদিদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে পাওয়া ৩০ লাখ ৫৪ হাজার ৮০৫ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি।
কম দামের মালপত্র বেশি দামে ক্রয়
রাজধানীর বকশীবাজারে অবস্থিত কারা সদর দপ্তর সয়াবিন তেল ও মসুর ডাল কেনার জন্য মেসার্স আইয়ুব আলী ট্রেডার্সের সঙ্গে ২৩১ কোটি ৩০ লাখ সাত হাজার ৪৪০ টাকার চুক্তি করেছে। চুক্তি যাচাই করে নিরীক্ষা দল দেখেছে, আট লাখ ৭০ হাজার লিটার সয়াবিন তেল দিতে প্রতিষ্ঠানটি দাম ধরেছে প্রতি লিটার ১১৮ টাকা ৭৮ পয়সা। অথচ চুক্তির সময় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাজারদর তালিকা অনুযায়ী, তখন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭৮ টাকা পাঁচ পয়সা লিটার। এই দরের সঙ্গে ভ্যাটসহ আনুষঙ্গিক খরচ ২৩ শতাংশ যুক্ত করলে তেলের বাজারদর দাঁড়ায় ৯৬ টাকা লিটার। বাজারদর থেকে প্রতি লিটারে ২২ টাকা ৭৭ পয়সা বেশি দেওয়ায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ৯৮ লাখ আট হাজার ৫৯৫ টাকা।
এমন আর্থিক অনিয়মের জবাবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাজারদর উপেক্ষা করা হয়নি। তখন বাজার যাচাই করে সর্বনিম্ন দরদাতার সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। যদিও নিরীক্ষা দল প্রতিবেদনে বলছে, তারা পরীক্ষা করে দেখেছে, কারা কর্তৃপক্ষের এমন বক্তব্য সঠিক নয়।
এদিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১-এ খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের জন্য সর্বনিম্ন দরদাতার সঙ্গে চুক্তি করা হয়নি। একই পণ্য উচ্চদরে কেনায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৫৪৬ টাকা। নিরীক্ষা দল তদন্তে দেখেছে, যেসব ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই কারা কর্তৃপক্ষের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। আবার কাশিমপুর কারাগারের পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে একইভাবে সর্বনিম্ন দরদাতাকে উপেক্ষা করে উচ্চমূল্যে পণ্য কেনায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে আরো ৪৪ লাখ ৫৬ হাজার ৬৯০ টাকা। এমন আরো ছয় কেনাকাটায় প্রায় এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা বেশি খরচ করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।
কেনাকাটায় পরিকল্পনা নেই
সিলেট ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার এবং কক্সবাজার জেলা কারাগারে কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই ২৩ কোটি ২৮ লাখ ২৬ হাজার ৫১৪ টাকার কেনাকাটা করা হয়েছে। এসব কেনাকাটায় বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনার কোনো নথি দেখাতে পারেনি কারা কর্তৃপক্ষ। অথচ সরকারি ক্রয়নীতি ২০০৮-এর ১৬{১} অনুযায়ী, বছরের শুরুতেই ক্রয় পরিকল্পনা করা বাধ্যতামূলক।
যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন অনিয়মের আপত্তির জবাবে বলছে, কারাগারে খাদ্যদ্রব্য কেনার জন্য আইটেমভিত্তিক দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং সে অনুযায়ী ক্রয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম করা হয়নি। তবে এমন জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেনি নিরীক্ষা দল।
এ ছাড়া কেরানীগঞ্জ, কাশিমপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রংপুর, রাজশাহী ও যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং বরিশাল ও কক্সবাজার জেলা কারাগারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ৮৪ কোটি ৭২ লাখ চার হাজার ৭১০ টাকার পণ্য কেনা হয়েছে, যা সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে।
সরকারি ওষুধ কেনা হয়নি
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, সরকারি যেকোনো দপ্তরে এসেনশিয়াল ড্রাগস লিমিটেড থেকে ওষুধ কিনতে হবে। তবে এসেনশিয়াল ড্রাগস যদি ওষুধ দিতে না পারে সে ক্ষেত্রে বাজার থেকে ওষুধ কেনা যাবে। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ সেই নিয়ম না মেনেই বাজার থেকে সাত কোটি ৮১ লাখ ৭০ হাজার ৫৫০ টাকার ওষুধ কিনেছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এটি একটি গুরুতর অনিয়ম। যদিও আপত্তির জবাবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারের টাকা বাঁচাতে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বাজার যাচাই করে বাইরে থেকে ওষুধ কেনা হয়েছে। তবে এমন কথার সঙ্গে একমত নয় নিরীক্ষা দল।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে কারাগারের এসব দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেহেতু সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাই এটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। সরকারের সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে এ বিষয়ে তদন্ত করা এবং এর সত্যতা খুঁজে বের করা। তা না হলে এজাতীয় দুর্নীতিগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে। ’