বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে প্রথমবারের মতো ধাক্কা খেল দেশের রপ্তানি আয়। ডলারের উচ্চমূল্য, মন্দার প্রভাব এবং দেশের গ্যাস ও বিদুৎ সংকটের কারণে রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। টানা ১৩ মাস পর গত মাসে (সেপ্টেম্বর) রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে একই মাসে বৈধ চ্যানেলে প্রবাস আয় (রেমিট্যান্স) এসেছে সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এই দুই সূচকে নেতিবাচক ধারার কারণে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নেমেছে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। গতকাল রবিবার দিনশেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৬.৩০ বিলিয়ন ডলার।
রপ্তানি আয় কমল
গতকাল রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সদ্যঃসমাপ্ত মাস সেপ্টেম্বরে ৩৯০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬.২৫ শতাংশ কম। অবশ্য সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রপ্তানি ইতিবাচক ধারাতেই আছে। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ১৩.৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রয়েছে। এ সময়ে এক হাজার ২৪৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি হয়েছিল এক হাজার ১০২ কোটি ডলারের পণ্য।
গত মাসে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মূলত পোশাক রপ্তানি কমে যাওয়ায়। গত মাসে ৩১৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৭.৫২ শতাংশ কম। গত মাসে ওভেন ও নিট উভয় ধরনের পোশাক রপ্তানিই কমেছে। তবে সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে পোশাক রপ্তানিতে ১৩.৪১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রয়েছে।
জানতে চাইলে বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘সাভার ও গাজীপুরে তীব্র গ্যাসসংকটের প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে রপ্তানি আয় কমছে। ’ তাঁর আশঙ্কা, খুব দ্রুত এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে না।
এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রপ্তানি গত সেপ্টেম্বর মাসে নেতিবাচক হলেও সার্বিক রপ্তানি এখনো ইতিবাচক। ডলারের উচ্চমূল্য, জ্বালানি তেলের সংকট এবং ক্রেতাদের আমদানি হ্রাস ও পণ্য নেওয়া স্থগিত করার ফলে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এটি আগামী কয়েক মাস থাকবে। ’ তবে এটি সাময়িক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যিক টানাপড়েনের কারণে বাংলাদেশ সুবিধা পাবে। ফলে সাময়িক উচ্চ প্রবৃদ্ধি না থাকলেও চীন থেকে স্থানান্তরিত বিনিয়োগের ফলে বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখা সম্ভব হবে। ’ এ জন্য তিনি গ্যাস ও বিদুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পরিকল্পনা থেকে আপাতত সরে আসার পরামর্শ দেন।
এদিকে ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে কৃষিপণ্য, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্প, বাইসাইকেল ও আসবাব রপ্তানি কমে গেছে। তৈরি পোশাকের পর সবচেয়ে বেশি ৩৫ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি হয়েছে।
বিজিএমইএ সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে তৈরি পোশাক রপ্তানি ১০.২৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩.৪১ শতাংশ বেশি। নিটওয়্যার রপ্তানি ৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যখন ওভেন রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে ৫.৬৬ শতাংশ।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধিতে মন্দার আশঙ্কা আগেই করা হয়েছিল, এখন তারই প্রতিফলন ঘটল। পরের দুই মাসও নেতিবাচক প্রভাব থাকতে পারে। ডিসেম্বর মাসে গিয়ে হয়তো পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাবে।
প্রবাস আয় সাত মাসে সর্বনিম্ন
প্রবাসীরা গত মাসে ১৫৪ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন। এটি গত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০.৮৪ শতাংশ এবং গত আগস্টের তুলনায় ২৪.৪ শতাংশ কম। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
গত আগস্টে ২০৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এর আগের মাস জুলাইয়ে এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। জুলাই মাসে পবিত্র ঈদুল আজহার কারণে বেশি পরিমাণ প্রবাস আয় আসে। তবে আগস্টে বড় উৎসব ছিল না, এর পরও প্রবাস আয় ২০০ কোটি ডলার ছাড়ায়।
ডলারের সংকট নিরসনে এবং প্রবাস আয় বাড়াতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিজেরাই বসে ডলারের দাম নির্ধারণ করছে। এতে প্রবাসীরা ডলারের দাম ভালো পাচ্ছেন।
কমছে রিজার্ভ
গতকাল দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমেছে ৩৬.৩০ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এর প্রধান কারণ চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রায় ৩৪০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। গত অর্থবছর বিক্রি করা হয় আরো ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার। গত বছরের ডিসেম্বরেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৬.১৫ বিলিয়ন ডলার। এখন রিজার্ভ ধরে রাখতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে নেতিবাচক ধারার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান কমল।
বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে
রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৫৫ কোটি ডলারে। একই সঙ্গে চলতি হিসাব ও সামগ্রিক লেনদেনেও ঘাটতি রয়েছে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি ভারসাম্যের হালনাগাদ তথ্যে এমন চিত্র উঠে এসেছে।