দুপুরের খাবার খেতে কর্মস্থল থেকে দিয়াবাড়ীর বাসার উদ্দেশে মোটরসাইকেলযোগে ফিরছিলাম। ওই এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনে রড-সিমেন্ট সাপ্লাই দিই আমি। ১৬ নম্বর সেক্টর পার হওয়ার সময় হঠাৎ একটি মেয়ে আমার মোটরসাইকেলের সামনে এসে পড়ল। শুধু বলছিল, ভাই, আমারে বাঁচান। এর পর কান্না শুরু করে মেয়েটি। এর পরই দেখি, কাশবনের ভেতর দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে এক লোক দ্রুত পালাচ্ছে। ওই লোকটিকে দেখিয়ে মেয়েটি বলছিল, ওই আমারে তুলে এনেছে। আমি ছিনতাইয়ের কবলে পড়েছি। আমার সবকিছু নিয়ে গেছে।’ ২৫ আগস্ট তুরাগ থানাধীন দিয়াবাড়ীর নির্জন কাশবন থেকে কীভাবে একটি মেয়েকে উদ্ধার করলেন, তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন আল-মামুন।
তিনি পেশায় নির্মাণসামগ্রী সরবরাহকারী। দিয়াবাড়ী এলাকায় ৯/১০ বছর ধরে বসবাস করছেন তিনি। আল-মামুন জানান, দিয়াবাড়ী এলাকায় একটি চতুর্থ তলায় নির্মাণাধীন ভবনে তাঁর কাজ চলছিল। দুপুর গড়িয়ে যাওয়ায় বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে মেয়েটির এ অবস্থা দেখে প্রথমে তুরাগ থানা পুলিশের ড্রাইভার আসলামকে ফোন করেন তিনি। ওই এলাকার বসতভিটা ও সেখানে ব্যবসাপাতি থাকায় পুলিশের দু’চারজন সদস্যের সঙ্গে পুরোনো চেনাজানা রয়েছে মামুনের। ফোন পাওয়ার দুই মিনিটের মধ্যে এসআই অপূর্বর নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল সেখানে যায়। এর পর পুলিশের গাড়িতে মেয়েটিকে থানায় নেওয়া হয়। ওই দিন বিকেলেই থানায় গিয়ে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বক্তব্য দেন মামুন। পরে তিনি জানতে পারেন, ওই মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ঘটনার দিন দুপুরে কল্যাণপুরে গিয়ে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। রিকশায় উঠে বাসার দিকে যাত্রা শুরু করেন তিনি। এমন সময় রিকশার গতিরোধ করে দাঁড়ায় মোটরসাইকেল আরোহী এক ব্যক্তি। তার মোটরসাইকেলে ‘পুলিশ’ লেখা স্টিকার। আর ওই ব্যক্তি নিজেকেও ‘পুলিশ বাহিনীর লোক’ হিসেবে পরিচয় দেয়। এর পর ছাত্রীর হাতে থাকা একটি ব্যাগের দিকে তাকিয়ে কর্কশভাবে বলতে থাকে, ‘এই ব্যাগে অবৈধ জিনিসপত্র রয়েছে। থানায় নেওয়ার কথা বলে ওই ছাত্রীকে অপহরণ করে দিয়াবাড়ীতে নিয়ে যায়। তার কাছে থাকা স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেওয়ার পর নিপীড়নের শিকার হন ওই ছাত্রী। পরে নিপীড়নের ঘটনার অনেক তথ্য আড়াল করে মামলা নেয় তুরাগ থানা পুলিশ। এ ছাড়া এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তুরাগ থানা এলাকায় পুলিশি নিরাপত্তার ফাঁকফোকরের বিষয়ও সামনে আসে।
ওই ছাত্রীর মা বলেন, ‘আমার মেয়ের ব্যাগে মাদক থাকার কথা বলে পুলিশ পরিচয় দিয়ে একজন দিন-দুপুরে তুলে নিল। গলায় ছুরি বসানোর হুমকি দিয়ে সবকিছু কেড়ে নিল। স্বাভাবিকভাবেই সে একটু ভয় পেয়েছিল। এখন ঠিকঠাক আছে। বলুন, কে এই শহরে নিরাপদ? অহরহ এ ঘটনা ঘটছে। আমার মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বলে হয়তো এখন লেখালেখি হচ্ছে। তবে সাত দিন হয়ে গেল; এখনও জড়িতকে গ্রেপ্তারের খবর নেই। আমরা চাই জড়িত ব্যক্তি দ্রুত গ্রেপ্তার হোক।’
ডিবির প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, এই আসামিকে ধরার চ্যালেঞ্জ আমরা নিয়েছি। এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও হাতে এসেছে। যে মোটরসাইকেলে তাকে তুলে নেওয়া হয়েছে; সিসিটিভির ফুটেজ দেখে তার নাম্বারপ্লেট মেলানোর কাজও চলছে। তার পরিচয় যা-ই হোক; পার পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরপুর, উত্তরা এলাকায় একটি চক্র পুলিশ পরিচয় দিয়ে মোটরসাইকেল ও অন্যান্য গাড়িতে পথচারীদের তুলে সবকিছু লুটপাট করে নিচ্ছে। কোনো নারী তাদের টার্গেট হলে তার কাছ থেকে জিনিসপত্র লুটপাটের পর নির্জন এলাকায় নিয়ে ধর্ষণের মতো ঘটনাও তারা ঘটাচ্ছে।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি মোর্শেদ আলম বলেন, যার মাধ্যমে পুলিশ ঘটনাটি প্রথমে জানতে পারে, তার বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি আমরা শুরু থেকেই গুরুত্ব দিচ্ছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী সমকালকে বলেন, এ বিষয়ে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যদের অবহিত করেছি। তবে শিক্ষার্থী, তার পরিবার, সহপাঠী ও বিভাগ- কোনো পর্যায় থেকেই আমাদের অবহিত করা হয়নি। একটা সূত্র থেকে আমার কাছে কিছু তথ্য এসেছিল। শিক্ষার্থী না বলা পর্যন্ত আমাদের কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে অপহরণের ঘটনা নিয়ে বুধবার সমকালের প্রতিবেদন প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে মেয়েটি ও তাঁর পরিবারকে সব ধরনের আইনি সহায়তা দেওয়ার কথাও বলা হয়।