দেশে চালের বাজারে অস্থিরতা এমন একসময় শুরু হয়েছে, যখন ভরা মৌসুম। এ মৌসুমে বাজারে চালের সরবরাহ সবচেয়ে বেশি থাকে। গত কয়েক দিনে চালের বাজারে যেভাবে দাম বেড়েছে, তা অস্বাভাবিক।
বাজারে চালের দাম বাড়ার কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, কোনো একটি সুনির্দিষ্ট কারণ কেউই শনাক্ত করতে পারছেন না। বেশ কয়েকটি বিষয় একযোগে কাজ করছে এর পেছনে।
চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে চালের ঘাটতি আছে। কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা মজুতদারি করছেন। আবার বাজারে ঘাটতি আতঙ্কও নানাভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
বাজারে অনুসন্ধান চালিয়ে এবং চাল উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে ৯টি কারণ শনাক্ত হয়েছে।
এগুলো হলো: দেশে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ধান উৎপাদনে বড় ধরনের ঘাটতি, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের পূর্বাভাস এবং তা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার, সংকট পুঁজি করে অনৈতিক মুনাফার আশায় ধান-চালের মজুত, বাজারে ধানের সরবরাহ কমে যাওয়া ও দাম বেড়ে যাওয়া, চালকলে চাল উৎপাদন আগের তুলনায় কমে যাওয়া, খোলাবাজার থেকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ধান-চাল কেনা, সরকারিভাবে চাল আমদানি না হওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া দাম এবং ২৫ শতাংশ শুল্কভার নিয়ে চাল আমদানিতে বেসরকারি খাতের নিরুৎসাহিত মনোভাব এবং ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে চাল উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি।
চালের বাজারে অস্থিরতার কারণ শনাক্ত করতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কোনো পর্যালোচনা এখনও নেই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ভরা মৌসুমে দেশে চাল নিয়ে এমন অস্থিরতা তৈরি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সেটিই হচ্ছে।’
তিনি এর কারণ হিসাবে বলেন, ‘এমন হতে পারে, কোনো ব্যবসায়ীই কোনো নিয়ম-কানুন মানছেন না। হতে পারে, কারও কারও অতি লোভ- এ রকমটাও হতে পারে। কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু করছে কি না সেটিও যাচাই করে দেখতে হবে।’
দেশে সর্বাধিক ধান উৎপাদন হয় বোরো মৌসুমে। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সময়ে এই ফলন গড়ায়। যার থেকে উৎপাদিত ধানের ৫৮ ভাগ সরবরাহ মেলে। এরপর শুরু হয় আউসের মৌসুম, যার ফলন বাজারে গড়াবে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই। ফলে চালের সরবরাহ আরও বাড়ার কথা। তাহলে চালের দামে এত অস্থিরতা কেন?
নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি নিরোধ চন্দ্র সাহা বলেন, চালের বাজারে অস্থিরতার পেছনে রয়েছে ঘাটতি।
তিনি বলেন, ‘চাল ব্যবসায়ীদের যেটা হিসাব, সেটা হলো ধান উৎপাদনে ঘাটতি আছে। তবে কী পরিমাণ ঘাটতি আছে, সরকার তার হিসাব স্পষ্ট করছে না। নানা মাধ্যমের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ব্যবসায়ীদের ধারণা জন্মেছে, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় দেশে ধান উৎপাদন ঘাটতি ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন। মূলত এটিই হলো অস্থিরতার বড় কারণ।
‘আবার এটাও সত্য, এই মৌসুমে চালের বাজার অস্থির হওয়ার কথা নয়। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বাজারে চালের দাম ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ার বিষয়টি আসলে আমরা নিজেরাও হিসাব করে পাই না। তবে ধারণা করছি, বেশ কিছুদিন ধরে নানা মাধ্যমে বলা হচ্ছে, বিশ্ব খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে। এ ধরনের সংবাদ পেলে আমাদের তো একটা চরিত্র আছে সুযোগ নেয়ার। ভোক্তাদের বেলায় তারা বেশি বেশি কেনেন। লাগবে এক বস্তা, নিয়ে যান দুই বস্তা। এতে প্যানিক সৃষ্টি হয়। বাজার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আবার কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছে, তারাও একটু সুযোগ নেয়।
‘এ ছাড়া ইদানীং দেশে যেসব বড় বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো বাজারে এসেছে, নানা আশঙ্কা থেকে তারা বড় লটে মার্কেট থেকে ধান-চাল কিনে নিয়েছে। তারা প্যাকেজিং চাল বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে বাজার থেকে একটা বড় পরিমাণ পণ্য তুলে নিচ্ছে। তাদের দেখে অন্যান্য সাধারণ ব্যবসায়ীও এর সুযোগ নিচ্ছে।’
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বাজারে এখন ধানের সংকট চলছে। কেউ তেমন আর ধান বিক্রি করছে না। ধানের সরবরাহ কমে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে দামও। মিনিকেট চাল তৈরি হয় এমন ধানের মণপ্রতি দাম এখন ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা, যা মাস কয়েক আগেও ছিল ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। আবার এই বাড়তি দামেও চাহিদা অনুযায়ী ধান পাচ্ছেন না মিলাররা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশ্ন, ধান না পেলে মিলগুলো চাল উৎপাদন বাড়াবে কীভাবে?
এর সঙ্গে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যোগ হয়েছে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি। এতে ধান থেকে চাল উৎপাদন খরচ কেজিতে বেড়েছে ২ টাকা। ফলে যে পরিমাণ চাল উৎপাদন হচ্ছে, তা বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে।
সেই বাড়তি দামের চাল ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে আরও বাড়তি দামে। কারণ মিলগুলো থেকে চাল পরিবহনের ভাড়াও বেড়েছে প্রতি কেজিতে ৬০ পয়সা এবং ৫০ কেজির বস্তায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা।
এতে ঢাকার খুচরা বাজারে চিকণ চাল বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৬ টাকায় এবং মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৬ টাকায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাবুবাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কাওসার আলম খান বলেন, ‘বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের ইস্যুটি দেশে প্যানিক সৃষ্টি করেছে। তার ওপর দেশে চাহিদা অনুযায়ী ধান-চালের সরবরাহে ঘাটতিও আছে। আবহাওয়াও এবার খারাপ ছিল। প্রথম যখন ধান লাগায়, তখন পানি নাই। তারপর বৃষ্টি। যখন কাটতে যায় তখন পানির নিচে। শুধু হাওরেই নয়, বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টিতে ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সবাই সচেতন। বিভিন্ন মাধ্যমে এ খবর চাউর হওয়ার পর কৃষক থেকে ব্যবসায়ী যার যে পরিমাণ ধান-চাল আছে, তারা পকেটে পকেটে মজুত করেছে। কেউ বাজারে ছাড়তে চাইছে না।’
বাবুবাজারের এ চাল ব্যবসায়ী চালের দাম বাড়ার পেছনে দেশে ধানের বাজারে সরবরাহ সংকটকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করেন।
চাল কেনার চাহিদা বাজারে থাকবে না
চালের বাড়তি দাম নিয়ে শুধু ক্রেতা-ভোক্তাই নয়, দুশ্চিন্তায় আছে সরকারও। তবে এটি নিয়ন্ত্রণে ধরপাকড়ে না গিয়ে সরকারি ব্যয় বাড়াতে যাচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘কারা ধান-চাল মজুদ করছে বা বাজারে ছাড়ছে, না তা দেখে তো বলতে পারব না। এ রকম খবর পেয়ে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে আমরা দুই-চারটা অভিযান পরিচালনা করেছি, সেখানে মামলা-মোকাদ্দমা হয়েছে। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে আমরা কৌশলী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘যদি মার্কেটে ডিমান্ড না থাকে, তাহলে কোনো কারণে কেউ যদি গোপনে চাল মজুতও করে থাকে, তাহলে তাকে চাল নিয়ে বসেই থাকতে হবে। কারণ, আগামী মাস থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ওএমএস কর্মসূচির আওতা ব্যাপকভাবে বাড়াতে যাচ্ছে। পাশাপাশি টিসিবির যারা ডিলার, তাদেরকেও চাল দেয়া হবে। এতে চালের দাম কমে যাবে।’
খাদ্য সচিব বলেন, ‘এই কার্যক্রমের মাধ্যমে সারা দেশে মাঠ-ময়দান চালে ভরপুর হয়ে যাবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি লোক ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে সেই চাল ১৫ টাকায় এবং ৩০ টাকা কেজি দরে কিনতে পারবে। যদি এতো কম দামে বেশি পরিমাণ চাল পায়, তাহলে ওদের গুদামে মোটা চালগুলো কিনবে কে?’
মিলছে দাম কমার পূর্বাভাস
ব্যাপকভাবে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির প্রস্তুতির আভাস পেয়ে বাজারে চালের দাম কমার পূর্বাভাসও দেখা যাচ্ছে। মিলাররা জানান, গত দুই-তিন ধরে চালের দাম কমতে শুরু করেছে। আড়তগুলোতেও দাম কমার তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আগামী সপ্তাহে তার প্রভাব খুচরা বাজারেও দেখা যেতে পারে।
নওগাঁর চালকল মালিক নিরোধ চন্দ্র সাহা জানান, দীর্ঘ অস্থিরতার পর চালের বাজারটি মোটামুটি তিন-চারদিন ধরে একটু কমতির দিকে।
একই তথ্য দিলেন রাজধানীতে চালের বৃহৎ আড়ত বাবুবাজারের চাল ব্যবসায়ী কাউসার আলম খান। তিনিও জানান, চালের দাম বাড়তি ছিল। এখন সেই দাম আড়তে এবং পাইকারি দুটোতেই কমেছে। সেটি খুচরা বাজারেও দ্রুত প্রভাব ফেলবে বলে তিনি মনে করেন।
দাম কমার যৌক্তিক কারণও সামনে অপেক্ষা করছে। ভাদ্র মাস চলছে। আউসের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে বকশালী ইরি বাজারে গড়াবে। তা ছাড়া বাজারে চালের সরবরাহ বাড়াতে খাদ্য মন্ত্রণালয় চালের আমদানি শুল্ক কমানোরও চিন্তাভাবনা করছে।
বর্তমানে চাল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আছে ২৫ শতাংশ। খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ অনুযায়ী এর থেকে শুল্ক ১০ শতাংশ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে চালে শুল্কহার ১৫ শতাংশে নেমে আসবে। খুব শিগগিরই এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। সরকারের এমন উদ্যোগে চাল আমদানিতে উৎসাহ পাবে ব্যবসায়ীরা। এতে দেশে চালের সরবরাহ বাড়বে। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হবে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম ক্রমশ কমে আসা।