স্বাধীন বাংলাদেশের আজকের এই ভূখণ্ডে চা এসেছিলো ১৮৪০ সালে ইংরেজদের হাত ধরে। চা উৎপাদনের এই ১৮০ বছরের ইতিহাস যেন ১৮০ বছরের চা শ্রমিক নির্যাতনের ইতিহাস। ইংরেজ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ কোনো আমলেই ন্যায্য মজুরি, নূন্যতম মানবিক সুযোগ সুবিধা পায়নি চা শ্রমিকরা।
সাম্প্রতিক আন্দোলনটি মূলত চা শ্রমিকদের মজুরি কেন্দ্রিক। শ্রমিকদের ভাষ্য, সারাদিন কাজের ১২০ টাকা মজুরি রক্ত চোষার নামান্তর। অথচ এই ১২০ টাকা মজুরি তারা পাচ্ছে গত কয়েকবছর যাবৎ। ২০১৫ সালেও চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ছিল ৬৫ টাকা। (সূত্র: চা-শ্রমিকদের জীবন!, প্রথম আলো, ১৬ জুন ২০১৫)
যেখানে গত ১৩ বছরে দেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে প্রায় দশগুণ,অথচ চা শ্রমিকদের আয় বেড়েছে সামান্য। মজুরি, সামাজিক সুবিধা, মৌলিক অধিকার সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়া এই ১৫ লক্ষাধিক চা শ্রমিককে যেন রাষ্ট্রের মূল ধারার নাগরিক হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে না। বরং শ্রমিকদের এইসব অধিকার নিয়ে বাগানে কাজ করতে গিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন সামাজিক অধিকার কর্মীরা। (সূত্র: সম্ভাবনাময় চা শিল্প শ্রমিকদের নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন অধিকার, সমকাল , ২৯ ডিসেম্বর ১৫)
আজকের এই আধুনিক যুগেও চা বাগান অঞ্চলে শিক্ষার হার আশংকাজনক ভাবেই কম। শিক্ষা ছাড়াও চিকিৎসা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন সবদিক থেকেই চা শ্রমিকদের দুর্দশা সীমাহীন। বাংলাদেশে প্রায় ২৫০ চা বাগানের কোথাও কোনো কলেজ নেই, ২টি হাইস্কুল এবং সর্বোচ্চ ১০টি প্রাথমিক স্কুল চা বাগান এলাকায় আছে ।
২০১০ সালে জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী পানি ও স্যানিটেশন মানুষের অধিকারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ চা বাগানেই শ্রমিকদের স্যানিটেশনের উপযুক্ত কোনো ব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের চরম ভোগান্তিতে কাজ করতে হচ্ছে। বাগান এলাকায় নিজস্ব গৃহ নির্মাণ করা দূরের বিষয়, টয়লেট নির্মাণের সুযোগ নেই চা শ্রমিকদের। দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, চা শ্রমিকদের ৫০ শতাংশ উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করে!
চা শ্রমিকের উপর শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে নেয়া হয় না। বহিরাগত লোক দিয়ে বাগানের নারী শ্রমিকদের উপর নির্যাতনের ঘটনা এবং শ্লীলতাহানির অভিযোগ আছে। পুরুষ কর্মীদের উপর হামলা এবং নির্যাতনের ঘটনা ঘটার দাবি রয়েছে একই বাগানে। (সূত্র: শ্রীমঙ্গলে চা বাগানে মালিক পক্ষের সাথে শ্রমিকদের সংঘর্ষ, ব্যবস্থাপকসহ আহত ৮, সিলেট টুডে ২৭ জুন, ২০১৫)
চা বাগানের কর্মীদের ছুটির পরিমাণও নগন্য। অন্যান্য সকল পেশায় মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয়মাস হলেও চা বাগানে তা মাত্র ২-৩ মাস। ফলে গর্ভাবস্থাতেও প্রতিদিন ১২৫ কেজি চা পাতা বহন করে পাহাড় বাইতে হয় নারী শ্রমিকদের। জাতীয় শ্রমনীতির বাৎসরিক ১০ দিন ছুটিও পান না অধিকাংশ চা শ্রমিক। উপরন্ত, এক বেলার অনুপস্থিতিতে দিনের বেতন কেটে নেবার অভিযোগ আছে। প্রায় সব শ্রমিককেই বছরে ৩৬০ দিনের বেশি কাজ করতে হচ্ছে।
চা শ্রমিকদের একটি বিরাট অংশ সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষ। তাদের নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য, ইতিহাসেরও সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক রাজু নুনিয়া বলেছিলেন, ‘এত কষ্টের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে, যখন সমাজের একটা বড় অংশ বলে যে আমরা ভারতীয়। আমরা যখন বঙ্গে আসি তখনো ভারতবর্ষ ভাগ হয়নি। এখানে সবার একটা পরিচয় আছে। কিন্তু চা-শ্রমিকদের সেটা নেই। আবার আমাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি থাকলেও নেই কোনো স্বীকৃতি।’
এই বছর ছিল চা শ্রমিকদের ‘মুল্লুকে চল’ আন্দোলনের ১০১ তম বার্ষিকী। ভুয়া তথ্যের প্রলোভনে পড়ে চা বাগানে কাজ করতে এসে নির্যাতনের মুখে ৩০,০০০ চা শ্রমিক রওনা দেয় বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। চা শ্রমিকরা মেঘনা ঘাটে পৌছালে গোর্খা সৈন্য মোতায়েন করে ব্রিটিশ সরকার। সেখানে নির্বিচারে গুলি শত শত চা শ্রমিককে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীতেই । শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয় মেঘনার পানি। এই দিনটির স্মরণে প্রতিবছর ২০ মে পালন করা হয় ‘চা শ্রমিক’ দিবস। এই দিবসটির নেই কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। অথচ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ যোগ্য এই মর্মান্তিক ঘটনা। সে সময় এই গণহত্যার প্রতিবাদ জানাতে ছুটে আসেন জাতীয় নেতারা।
১৯৭১ সালেও রক্ত দিয়েছে চা শ্রমিকরা। পাক বাহিনীর গণহত্যার সাক্ষী চা বাগানের শ্রমিকরাও। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে চা শ্রমিকরা তীর-ধনুক নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। এ সময় দেশের জন্য অনেক চা শ্রমিক জীবনও দিয়েছে। কিন্তু চা শ্রমিকরা এখনও এ দেশে পরবাসীর মতো আছে। তাদের নেই ভূমির অধিকারও।সময় এসেছে ২০ মে কে “চা শ্রমিক দিবস” হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি দেয়ার।
চা শ্রমিকদের এই বঞ্চনার অবসান আনতেই হবে। প্রায় ২০ লক্ষ চা শ্রমিককে তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্য সম্মান দিতেই হবে। চা শ্রমিকদের কেবল বেতন বৃদ্ধি নয় মানবিক সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে এটি জাতীয় ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত থাকবে।