ধর্ম আলোকিত মানুষের জন্য আলোর দিশারী, অন্ধকারে আটকে থাকা মানুষদের জন্য অনিয়ন্ত্রিত ধ্বংসাত্মক অস্ত্র। ধর্মকে কেন্দ্র করে সম্প্রীতি, আবার ধর্মকে কেন্দ্র করেই হানাহানি। এই একটি বিষয় থেকে পরস্পর বিরোধী দুইরকম ফল উৎপন্ন হচ্ছে। তাহলে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করছে, মানুষ ধর্মীয় নিয়মকানুনে নিয়ন্ত্রিত নয়।
আমাদের দেশে মুসলিমগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমাদের পাশের দেশ ভারতে সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ। ধর্মীয়দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার এক বিশাল সুবিধা রয়েছে, তবে তা শুধু ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ ধার্মিকদের জন্য। যখন ইচ্ছে হলো মন্দিরে হামলা করলাম, আবার যখন ইচ্ছে হলো গোমাংসে নিষেধাজ্ঞা দিলাম। নিরপরাধ মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে, অন্য ধর্মাবলম্বীর খাবারে নিষেধাজ্ঞা আরোপে কিভাবে ধর্মচর্চা ও ধর্মরক্ষা হয় তা বুঝা খুবই দুষ্কর!
ভারতের সমস্যা ভারতের, আমি বরং আমার দেশের সমস্যা নিয়ে কিছু বলি। আমরা জাতি হিসেবে এখনো পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারলাম না, কিন্তু ধর্মের ঠিকাদারি নিতে তৎপরতার শেষ নেই। প্রতিদিনের গল্পে পরনিন্দা ছাড়া জমে না, রাগ, অহংকার, হিংসা, ব্যভিচার ইত্যাদি আমাদের সবার জীবনে খুবই স্বাভাবিক বিষয়। অথচ ধর্ম সবসময় এসবের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়, এসবের চর্চা ধর্মের সবচাইতে বড় অবমাননা। কিন্তু কোনো পথভ্রষ্ট স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ধর্মের অবমাননা করলে, ধর্মান্ধরা ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরো জনগোষ্ঠীর উপর। নিজের বিবেক বিসর্জন দিয়ে হামলা করতে পিছপা হয়না নিজেরই প্রতিবেশীকে। ধর্মীয় দ্বন্দ্বের অনেক কারণ থাকতে পারে, হতে পারে তা রাজনৈতিক, ব্যাক্তিগত কিংবা গোষ্ঠীগত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জাগতিক অন্যান্য দ্বন্দ্ব যেমন অনেকাংশে বিনা হানাহানিতে নিষ্পত্তি হয়, ধর্মীয় দ্বন্দ্ব তেমনভাবে শেষ হয়না। মানুষের অন্ধত্ব বিবেক ও মানবতাকে হত্যা করে।
জাতির ও দেশের ক্রান্তিকালে ধর্মীয় দ্বন্দ্ব গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনা। তখন মানুষ বিপদে নিজেদের অবস্থান টের পায়। বুঝতে পারে মানুষ মানুষের জন্য। উপকার তখন মসজিদ, মন্দির, বিহার ও গির্জা কোথা থেকে আসলো তা বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না। বিপদ কেটে গেলে যেখানে আমরা সৃষ্টিকর্তাকেই ভুলে যাই, সেখানে উপকারীকে ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক না। আমরা সামান্য কঠিন মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করি, সেখানে ক্ষুদ্রকায় ধর্মীয় দ্বন্দ্বে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। মানুষের নানা বর্ণ, বিভিন্ন ধর্ম। কেউ যদি শিশুকাল থেকে সঠিক শিক্ষায় বেড়ে উঠে, আলোকিত হয়, সে কখনো তার শিক্ষকের, বন্ধুর ও প্রতিবেশীর মাঝে ধর্ম খুঁজে বেড়াবেনা। আমরা ধর্মীয় সম্প্রীতির অলীক স্বপ্ন দেখি, যেখানে ধর্মেরই সঠিক চর্চা নেই সেখানে সম্প্রীতি আশা করা বোকামি। মানুষ হতে না পারলে ধার্মিক হওয়া অসম্ভব, মানবপ্রেমের চর্চা না হলে ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করাও অসাধ্য!