কোভিড -১৯ করোনার কারণে গত বছর দেশের মোটরসাইকেল খাতে তৈরি হওয়া মন্দাভাব এ বছর কাটিয়ে ওঠার আশায় ছিলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এরই মধ্যে ডলারের বাজারে অস্থিরতার পর দাম বেড়ে যাওয়া ও এখন মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলে সরকার কঠোর হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যাশিত ব্যবসা না হওয়ার শঙ্কা করছে কোম্পানিগুলো।
পদ্মা সেতু সবার জন্য খুলে দেওয়ার পর ২৬ জুন মোটরবাইক দুর্ঘটনায় দু’জনের মৃত্যু হয়। এরপর সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
তারপর চলতি মাসের ৩ তারিখে ঈদুল আজহার সাত দিন সারা দেশের মহাসড়কে যৌক্তিক কারণ ছাড়া মোটরসাইকেল না চালানোর পাশাপাশি এক জেলায় রেজিস্ট্রেশন করা মোটরসাইকেল অন্য জেলায় না চালানোর নির্দেশ দেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
কোম্পানিগুলো বলছে, ঈদে নতুন মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা করে তাদের কাছে যে ক্রেতারা অর্ডার দিয়েছিলেন, সরকারের নির্দেশনা দেখে তারা আগের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের সিদ্ধান্ত যদি বহাল থাকে তবে লোকসানের শঙ্কাও করছে তারা।
জাপানের ব্র্যান্ড সুজুকির কাকরাইল শো রুমের ইনচার্জ সামসুজ্জামান বাদল বলেন, ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে বাইকের দাম আগেই বেড়েছিল। তারপরও প্রত্যাশা ছিল ঈদে ভালো বিক্রি হবে। কিন্তু মহাসড়কে বাইক চলাচল নিষিদ্ধের ঘোষণায় বিক্রির গতি কমেছে।
তিনি বলেন, ক্রেতারা এখন বলছেন, আস্তে-ধীরে ঈদের পর সরকারের অবস্থা দেখে বাইক কিনবেন তারা। এ কারণে বিক্রি কমেছে।
টিভিএস অটো বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিপ্লব কুমার রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবার ঈদে প্রত্যাশার তুলনায় ৩০ শতাংশ মোটরসাইকেল কম বিক্রি হবে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়ে যাওয়াসহ বেশ কিছু কারণে মোটরসাইকেলের দামও বেড়ে যায়। এ কারণে বিক্রি কিছুটা কমে উল্লেখ করে বিপ্লব কুমার রায় বলেন, কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা ছিল ঈদের সময় বিক্রি বাড়বে। কিন্তু সরকারের নতুন নির্দেশনার কারণে বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।
তিনি বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে আমাদের ১ লাখ ২ হাজার মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিক্রি হয় ১ লাখ ৮ হাজারটি। বিক্রি বেড়েছে কিন্তু প্রত্যাশা অনুসারে বাড়েনি।
এরইমধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া হবে না বলে গতকাল জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
এ সিদ্ধান্ত মোটরসাইকেল বিক্রির ওপর নেতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলবে কি না জানতে চাইলে বিপ্লব কুমার রায় বলেন, আমরা বৈধ লাইসেন্সধারীদের কাছেই মোটরসাইকেল বিক্রি করতে চাই। এক্ষেত্রে সরকারের উচিৎ বাইকারদের লাইসেন্স দেওয়ার আগে প্রশিক্ষিত করা।
বাংলাদেশে জাপানের ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই মটরস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, দেশের ৯০ শতাংশ তরুণ ইয়ামাহা মোটরসাইকেল পছন্দ করে। তাই বিক্রি বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক সমস্যার কারণে ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়েছে। সে কারণে মোটরসাইকেলের দামও বেড়েছে ৩ শতাংশ। দাম বাড়ায় বিক্রিতেও কিছুটা প্রভাব পড়েছে। সরকার যদি মহাসড়কে একেবারে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করে দেয় তবে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
ঢাকার একটি ব্যাংকে চাকরি করেন শরিয়তপুরের ছেলে আসাদুজ্জামান। তার ইচ্ছা ছিল পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এই সেতু দিয়ে নিজের মোটর সাইকেলে বাড়ি ফিরবেন তিনি। কিন্তু এখন দেখছেন পদ্মা সেতুতে বাইক চলাচল নিষিদ্ধ।
আসাদুজ্জামান বলেন, এটা যদি সাময়িক হয়, তাহলে আমি বাইক কিনবো। আর যদি একেবারে নিষিদ্ধ হয় তাহলে কিনবো না।
গত চার বছর ধরে ঈদের সপ্তাহ দুয়েক আগে স্ত্রী সন্তানকে ট্রেনে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে ছুটিতে বাইকে করে বাড়ি ফেরেন সানজিদ রুপল। তিনি বলেন, ঈদের সময় রাস্তায় যানজট থাকে, তাই বাইকে করে অল্প সময়ে বাড়িতে যেতে পারি। এবারের পরিকল্পনাও সেই রকম ছিল। এখন সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে জ্যামেও থাকতে হবে, ভাড়াও বেশি দিতে হবে।
দেশীয় ব্র্যান্ড রানার অটোমোবাইল লিমিটেডের বিপণন বিভাগের প্রধান (এজিএম) মাহফুজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৭ হাজার বাইক বিক্রি হয়েছে। এ বছরও কাছাকাছি হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল এবার বেশি বিক্রির, কিন্তু ডলারের রেটের কারণে বাইকের দাম বেড়েছে। এখন সরকারের একের পর এক সিদ্ধান্তের কারণে বিক্রি কমছে। তিনি বলেন, গত ঈদের তুলনায় এবারের ঈদের বিক্রি একেবারেই কম।
আয় কমার ভয়ে মহাসড়কে বাইক বন্ধ করিয়েছেন বাসমালিকরা
মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের এ সিদ্ধান্তে ব্যাপক ক্ষোভ জানিয়েছেন বাইকাররা। বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে নিয়মিত সমালোচনা চলছে। দুর্ঘটনার কারণে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের বিষয়টিকে মাথা ব্যথা তাই মাথা কেটে ফেলার সঙ্গে তুলনা করছেন অনেকে। এ ছাড়া সরকারের সিদ্ধান্তের পেছনে বাসমালিকদের হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধন করে ঈদের আগে ও পরে মহাসড়কে সাতদিন মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান অর্ধশতাধিক বাইকার। আয় কমার ভয়ে মহাসড়কে বাইক বন্ধ করিয়েছেন বাসমালিকরা, এমন অভিযোগও করা হয় ওই মানববন্ধন থেকে।
ফেসবুকে বাইকারদের একটি গ্রুপের অ্যাডমিন মমিন তাজ মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে বলেন, মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধের পেছনে বাস মালিকদের হিংসাত্মক মনোভাব রয়েছে। বাস মালিকদের ঈদে আয় কমে যাওয়ার ভয় থেকেই তারা উপর মহলে চাপ সৃষ্টি করে এই বাইক চলাচল বন্ধ করেছে।
মোটরসাইকেল চলুক, চায় যাত্রী কল্যাণ সমিতিও
ঈদযাত্রায় গতি কমানোসহ কয়েকটি শর্তে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটি বলছে, আসন্ন ঈদযাত্রায় মহাসড়কে মোটরসাইকেলে রাইডশেয়ারিং বন্ধের সিদ্ধান্তকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত বাইক নিয়ে চলাচলকারীদের যাত্রাপথে হয়রানি করা হলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে।
তারা আরও বলছে, বর্তমানে দেশে ৩৭ লাখের বেশি মোটরসাইকেল রাস্তায় চলছে। গণপরিবহন সংকট, বাস মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা, পদে পদে যাত্রী হয়রানি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য, রেলের টিকিট অব্যবস্থাপনা, শিডিউল বিপর্যয়, যানজটসহ নানা কারণে ক্রমে মানুষ মোটরসাইকেলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ঝুঁকিপূর্ণ এই বাহনটি কখনোই গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না। এ অবস্থায় দেশের সড়কের তুলনায় মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এই বাহনটির নিবন্ধন বন্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তার আগে গণপরিবহন সংকট সমাধান করা, যাত্রী সেবার মানোন্নয়ন, যাত্রী হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
গত ঈদে দুর্ঘটনার শীর্ষে ছিল মোটরসাইকেল
ঈদুল ফিতরের আগে-পরের ১২ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল বলে ঈদের পরে জানিয়েছিল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেভ দ্য রোড। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলেছিল এ সংখ্যা ৩৭৬। আর যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছিল নিহতের সংখ্যা ৪৪৩।
তবে তিনটি সংগঠনের হিসাবেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে।
সেভ দ্য রোড বলেছিল, ১২ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৮১ জন নিহতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। নিয়ম না মানা ও হেলমেট ব্যবহারে অনীহার কারণে ১ হাজার ৬১৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৯৬৮ জন আহত এবং ১৯০ জন নিহত হন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনে ঈদ ঘিরে ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের নিহত হওয়ার খবর দিয়েছিল। তাদের হিসাবে ২০২১ সালে ঈদুল ফিতর উদযাপনের সময় ১২১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৩৪ জন নিহত হয়েছিলেন। সে হিসেবে দুর্ঘটনা বাড়ে ৫.৭৪ শতাংশ এবং প্রাণহানি বাড়ে ১৬.৪১ শতাংশ।
ঈদ ঘিরে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছিল, দুর্ঘটনার শীর্ষে ছিল মোটরসাইকেল। ১৬৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৪৫ জন নিহত এবং ১১০ জন আহত হয়েছেন; যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৪.০৮ শতাংশ, নিহতের ৩৪.৮৫ শতাংশ এবং আহতের ১৩.০৩ শতাংশ প্রায়। প্রকৃতপক্ষে দেশে বর্তমানে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক ক্যান্সারের মতো বেড়ে যাওয়ার কারণে পঙ্গু হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ পঙ্গু রোগী ভর্তি হলেও ঈদের এইসময়ে ২০০ থেকে ২৫০ জন প্রতিদিন ভর্তি হয়েছে।