এ বছর প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তবে বাজেটের আকার বড় হলেও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পাশাপাশি বাংলাদেশের শিক্ষা বাজেটে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক বিদ্যমান থাকলেও করোনা মহামারির জন্য অনেক শিক্ষার্থী আর্থিক কারণে মৌলিক শিক্ষা থেকে ছিটকে গেছে। তবে এসব শিক্ষার্থীকে শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা বিষয়ে বর্তমান শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দের স্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই বলেও মনে করছেন তারা।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ (জিডিপির অনুপাতে) গত ২০ বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। ইউনেস্কোর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে অন্তত জিডিপির ছয় ভাগ বরাদ্দ রাখা উচিত। অথচ বছরের পর বছর বাংলাদেশের বরাদ্দ দুই শতাংশের আশপাশেই সীমাবদ্ধ। এবারের বাজেটে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের তুলনায় কমছে। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট জিডিপির আকার ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা, যা শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির এক দশমিক ৮৩ শতাংশ।
অপরদিকে মালয়েশিয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ ছিল শিক্ষা খাতে, যার পরিমাণ ছিল ৫০ দশমিক চার বিলিয়ন মালয়েশিয়ান রিংগিত, যা সরকারি ব্যয়ের ১৫ দশমিক ছয় শতাংশ। নেপাল ২০২১-২২ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রেখেছে মোট বাজেটের ১১ শতাংশ, যা জিডিপির চার শতাংশ। ভুটান ২০২১-২২ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রেখেছে শিক্ষা খাতে, যার পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন নেপালি রুপি, যা সরকারি ব্যয়ের ১৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জিডিপির তিন দশমিক এক শতাংশ। এছাড়া শিক্ষা খাতে ব্রাজিলে জিডিপির ছয় শতাংশ, আফ্রিকার দেশ ঘানায় চার শতাংশ বরাদ্দ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা বাজেটের দিকটি প্রতিনিয়তই অবহেলিত।
দেশের শিক্ষা পদ্ধতির দুর্বলতা ও করোনা পরিস্থিতিতে ক্ষতি বিবেচনায় শিক্ষাবিদরা অনেক দিন ধরেই জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ এবং জিডিপির ছয় শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ইউনেস্কোর পরামর্শও ছিল, একটি দেশের মোট জিডিপির ছয় শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির তুলনায় শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল দুই দশমিক শূন্য আট শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল দুই দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। কিন্তু এবার তা আরও কমল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য গত বছর বরাদ্দ করা হয়েছিল ৩৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা।
এবার বাজেট বাড়িয়ে ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে এবারের বাজেটে। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। গতবারের চেয়ে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে এবার ৫৭৪ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য এবার ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। গতবারের চেয়ে এবার পাঁচ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ করা হলো।
তবে প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ চলতি অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে। আগামী অর্থবছরে মোট বাজেটের ১২ দশমিক শূন্য এক শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ছিল ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ। এছাড়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়; শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আমার সংবাদকে বলেন, শুধু শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না। এটা বাড়ানোর সাথে সাথে এই বাজেটের যেন যথোপযুক্ত ব্যবহার হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমরা প্রায়ই দেখতে পাই শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে, সেখানেই দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষা প্রশাসনের লোকজন।
তিনি আরও বলেন, আগামীতে আমরা এমন লোকবল শিক্ষা প্রশাসনে দেখতে চাই— যারা শিক্ষা খাতের বরাদ্দকে মনে করবেন নিজের পরিবারের জন্য বরাদ্দ। যেমন, নিজের পরিবারের খরচ করতে তিনি চারদিক বিবেচনা করেন, ঠিক এখানেও সে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ইউনেস্কোর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে জিডিপির অন্তত ছয় ভাগ এবং মোট বাজেটের ১২ থেকে ১৫ ভাগ শিক্ষায় বরাদ্দ রাখার কথা বলা হলেও আমরা তা করতে পারছি না। আমরা বলছি দক্ষ জনশক্তি তৈরি করব; কিন্তু তাদের দক্ষ করে তোলার জন্য যে কারিগরি প্রশিক্ষণ বা দক্ষতা অর্জনে যে বিনিয়োগের প্রয়োজন, তা পর্যাপ্ত নয়।
এদিকে শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দের বেশিরভাগই চলে যায় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যায় প্রশাসনিক খরচ মেটানোর পর গবেষণার জন্য তেমন কিছুই থাকে না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ গবেষণা করা। এদিক দিয়েও শিক্ষার বর্তমান বাজেট পর্যাপ্ত নয়। অনেক মন্ত্রণালয় আছে, তাদের জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয়, সেগুলোয় অনেক অর্থ উদ্বৃৃত্ত থেকে যায়, এক্ষেত্রে সেসব মন্ত্রণালয়ের বাড়তি অর্থ দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো যেতে পারে।
তাছাড়া করোনাকালীন সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে, সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ‘লার্নিং রিকভারি’র একটি উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল। করোনাকালীন সময়ে যেসব শিক্ষার্থী দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণিতে গেছে, সে কিন্তু মাঝের এ সময়টাতে তেমন কিছুই শিখতে পারেনি। অপরদিকে অনলাইনের শিক্ষাও পর্যাপ্ত ছিল না।
সেহেতু ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের ওপর স্টাডি করে আলাদা বরাদ্দ দেয়ার প্রয়োজন ছিল। বিশেষভাবে বরাদ্দের এই অর্থ শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ক্লাস অথবা কোচিং একটি ভালো বিকল্প হতে পারত।
এছাড়া শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তার যথাযথ ব্যবহার হয় না। বরাদ্দ বাড়লেই যে শিক্ষার মান বাড়বে— তা কিন্তু নয়। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চমাধ্যমিকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে বা অন্য কাজে যে বরাদ্দ থাকে, তার স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয় না। এক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অপচয় করেই বরাদ্দের একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকার আমার সংবাদকে বলেন, বাজেট বরাদ্দই শুধু শেষ কথা নয়। গুরুত্ব দেয়া উচিত বাজেট বাস্তবায়নের দিকে। বাজেট তখনই সফল হয়, যখন বাজেটে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়। এর জন্য বাজেটের একটি নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি থাকা জরুরি। যে বাজেটে নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি থাকে না, সে বাজেট কখনো জনমুখী হয় না। নৈতিকতাবিবর্জিত ও দর্শনহীন বাজেটে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ে, সম্পদের অপচয় হয় এবং ভারসাম্যহীন সমাজ তৈরি হয়। বাজেট শিক্ষাবান্ধব ও জনবান্ধব না হলে দেশ এগোয় না, সে সাথে সমাজও এগোয় না।